ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের মূলনীতি – ২ স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার

Islamic principles

২. স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার

স্বাধীনতার ও  পথনির্দেশনার অধিকার মানবতার দুটি মৌলিক দিককে একত্রে করে উপস্থাপন করে, যা ইসলামিক দার্শনিক ঐতিহ্যের গভীরে নিহিত। এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি অপরিহার্য মানবাধিকার হিসাবে স্বাধীনতার (Liberty/Freedom) স্বীকৃতি রয়েছে। যা পশ্চিমের লিবারেল সমাজে একটি নীতি হিসেবে জন লক এবং জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের দ্বারা চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। অনেক দেশ, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে আইন ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা এই অধিকারের বাস্তবায়ন ও প্রতিফলন হয়েছে। এই অধিকার ব্যক্তিদের তাদের নিজস্ব পছন্দ এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জীবনযাপন করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, যতক্ষণ না এটি অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে। পথনির্দেশনার (Guidance) ধারণা ইসলামিক কাঠামোর মধ্যে নিহিত। যা বিশ্বাস করে যে সমস্ত সৃষ্টিকে ঐশ্বরিক পথনির্দেশনা প্রদান করা হয়, যা আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের জীবন চলার পথ পূরণ করতে সক্ষম করে। এই নির্দেশিকা, স্রষ্টার কাছ থেকে উদ্ভূত, যা ব্যক্তিদের দিকনির্দেশনা এবং সহায়তা প্রদান করে।  এই নির্দেশনা যা তাদের জীবনকে বিজ্ঞতার সাথে এবং নৈতিকভাবে পরিচালিত করতে সহায়তা করে। এটা মানুষের অধিকার তার স্রষ্টার কাছে যে সে জীবনে চলার জন্য পথনির্দেশনা পাবে, আর এই অধিকারকেই আমরা পথনির্দেশনার অধিকার বলছি। স্বাধীনতার অধিকারের ও পথনির্দেশনার অধিকার একে ওপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।  এই দুটি অধিকার পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্য তৈরি করে। আমরা এই অধিকার দুটিকে প্রথমে পৃথক ভাবে ব্যাখ্যা করবো, পরে একত্র করে একটি অধিকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করবো। 

২.১ স্বাধীনতার অধিকার বলতে আমরা কী বুঝি:

স্বাধীনতার অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার যা অনেক দেশে আইন ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা স্বীকৃত এবং সুরক্ষিত। এই অধিকারটি নিশ্চিত করে যে ব্যক্তিদের তাদের জীবনযাপন করার স্বাধীনতা রয়েছে যেভাবে তারা উপযুক্ত মনে করে, যতক্ষণ না তারা অন্যদের ক্ষতি করে। জীবনের অধিকারের পরে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার হিসাবে বিবেচিত হয়। স্বাধীনতার অধিকারটি ব্যক্তির স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসনের ধারণার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। অর্থাৎ ব্যক্তিদের তাদের জীবনযাপনের বিষয়ে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত এবং পছন্দ করার স্বাধীনতা আছে।

স্বাধীনতার অধিকার মানুষের মর্যাদা এবং গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য মৌলিক স্বাধীনতার বিস্তৃত পরিসরকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর অধীনে প্রতিটি স্বাধীনতা ব্যক্তির স্বায়ত্তশাসন এবং একটি মুক্ত সমাজের কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে বাকস্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, পছন্দের স্বাধীনতা, সংঘ বা সমিতি করার স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত। সংক্ষিপ্তকারে এসব স্বাধীনতার একটি বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো:

বিশ্বাসের বা ধর্মের স্বাধীনতা: এই স্বাধীনতা ব্যক্তিদের তাদের পছন্দের ধর্ম অনুসরণ করতে বা কোনো ধর্মকে অনুসরণ না করার অনুমতি দেয়। এটি একজনের ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তন করার এবং প্রকাশ্যে এবং ব্যক্তিগতভাবে এই বিশ্বাসগুলি অনুশীলন ও পালন করার অধিকার অন্তর্ভুক্ত।

বাকস্বাধীনতা: গোষ্ঠী বা সরকারের প্রতিশোধ বা সেন্সরশিপের ভয় ছাড়াই নিজের মতামত ও ধারণা প্রকাশের অধিকার। এই স্বাধীনতার মধ্যে সীমানা নির্বিশেষে সকল প্রকার তথ্য ও ধারণা খোঁজা, গ্রহণ এবং প্রদানের অধিকার অন্তর্ভুক্ত।

দল গঠনের স্বাধীনতা: এই স্বাধীনতা ব্যক্তিদের একত্রিত হতে এবং সম্মিলিতভাবে তাদের ধারণা প্রকাশ, প্রচার, অনুসরণ এবং রক্ষা করার অনুমতি দেয়। এটি দল, সমিতি, ইউনিয়ন, এবং অন্যান্য গোষ্ঠী গঠন এবং যোগদানের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করে।

চলাফেরার স্বাধীনতা: একটি দেশের (!) অভ্যন্তরে অবাধে ভ্রমণ করার এবং নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার অধিকার। এটি একজন ব্যক্তির স্বাধীনতার জন্য মৌলিক যেখানে তারা বেছে নেয় সেখানে বসবাস করা এবং কাজ করা।

সমাবেশের স্বাধীনতা: সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার অধিকার। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিবাদ, মিটিং এবং প্রকাশ্য বিক্ষোভে অংশগ্রহণের অধিকার।

পশ্চিমা বিশ্ব সহ বিভিন্ন দেশে এই অধিকারগুলি আইন ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। ব্যক্তি ও সমাজের মঙ্গল ও উন্নতির জন্য স্বাধীনতার অধিকার অপরিহার্য এবং এটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর। এই অধিকারটি প্রায়শই অনির্বাণ হিসাবে দেখা হয়, যার অর্থ এটি কোন সরকার বা অন্য কর্তৃপক্ষ দ্বারা কেড়ে নেওয়া বা লঙ্ঘন করা যায় না। এটি প্রায়শই সার্বজনীন হিসাবেও দেখা হয়, যার অর্থ এটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। সামগ্রিকভাবে, স্বাধীনতার অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার যা ব্যক্তি ও সমাজের মঙ্গল ও বিকাশের জন্য অপরিহার্য। এই অধিকার রাজনৈতিক চিন্তাধারা অংশ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর। এই অধিকার রক্ষা করা এবং ব্যক্তিরা যাতে স্বাধীনভাবে তাদের জীবনযাপন করতে পারে তা নিশ্চিত করা সরকার এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।

জন লক (১৬৩২ – ১৭০৪), একজন প্রভাবশালী দার্শনিক ও চিন্তাবিদ, জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার সহ প্রাকৃতিক অধিকারের পক্ষে যুক্তি দেন। তিনি বলেন যে ব্যক্তিদের এই অধিকারগুলো তাদের সহজাত বা প্রাকৃতিক অধিকার এবং সরকারগুলি তাদের সুরক্ষার জন্য কাজ করা ও প্রতিষ্ঠান তৈরী করা উচিত। 

ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪): কান্ট, একজন জার্মান দার্শনিক, তার নৈতিক দর্শনে মানুষের মর্যাদার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে প্রতিটি ব্যক্তির অন্তর্নিহিত মূল্যকে সম্মান করা ব্যক্তিদের কর্তব্য, যার মধ্যে ব্যক্তি অধিকার এবং স্বাধীনতার নৈতিক ভিত্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬ – ১৮৭৩), তার রচনা “অন লিবার্টি” (১৮৫৯) এ স্বাধীনতার ধারণায় প্রবর্তন করেন ও অবদান রাখেন। তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতির পক্ষে যুক্তি দেন, উল্লেখ করে যে ব্যক্তিদের তাদের ইচ্ছামত কাজ করতে স্বাধীন হওয়া উচিত যতক্ষণ না তাদের কর্ম অন্যদের ক্ষতি করে।

২.২ পথনির্দেশনা এবং পথনির্দেশনার অধিকার বলতে আমরা কী বুঝি:

পথনির্দেশনা বা গাইডেন্স, এটি সাধারণ অর্থে, ব্যক্তির পথ পরিচালনা করার জ্ঞান ও উপলব্ধিকে বোঝায়। পথনির্দেশনা ব্যক্তির জ্ঞাত সিদ্ধান্ত নিতে বা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যগুলি অর্জনে সহায়তা করার জন্য দিকনির্দেশ, পরামর্শ, উপলব্ধিকে বোঝায়।। এটি কাউকে বা কিছুকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের দিকে বা নৈতিকভাবে ন্যায়পরায়ণ পদক্ষেপের দিকে চালিত করার জন্য নির্দেশ বা সহায়তা প্রদানের প্রক্রিয়া সাথে সম্পর্কিত। গাইডেন্স হল এমন একটি ধারণা যা ব্যক্তিদেরকে তাদের জীবন যাপন করার বিষয়ে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত এবং পছন্দ করতে গাইড করে।

সূরা আত-ত্বহা (২০:৫০):

 “আমাদের পালনকর্তা তিনিই যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তাকে পথনির্দেশনা দেখান।” 

আল্লাহ, যিনি পরম হক্ব, তিনি মহাবিশ্বে প্রতিটি বস্তু সৃষ্টি করেন এবং নির্দেশনা দিয়েছেন৷ এই প্রসঙ্গে, “পথনির্দেশ” বা হেদায়েত বলতে বোঝায় মহাবিশ্বের প্রতিটি সৃষ্ট বস্তুর জন্য আল্লাহর দ্বারা প্রদত্ত ঐশ্বরিক নির্দেশ বা নির্দেশনা। এটি ইঙ্গিত করে যে প্রতিটি জিনিসকে তার অস্তিত্ব দেওয়ার পরে, আল্লাহ সেই সৃষ্টির উদ্দেশ্য, দিকনির্দেশনা এবং কার্যকারিতার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে চলেছেন। এই  “পথনির্দেশ” বা হেদায়েত কোনো এককালীন বিষয় নয় বরং এটা চলমান এবং সবসময়ের জন্য। মানুষ তার জন্ম থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই পথনির্দেশনা পায়। এই অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন “পথনির্দেশনা” শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং মহাবিশ্বের সৃষ্টির সমস্ত উপাদানে বিস্তৃত। 

সূরা আল-আনকাবুত (২৯:৬৯): 

“এবং যারা আমাদের জন্য সংগ্রাম করে, আমরা অবশ্যই তাদের আমাদের পথ দেখাব। এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে আছেন।”

এই আয়াতটি ইঙ্গিত করে যে আমাদের পথনির্দেশনা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। যারা পথনির্দেশনা অন্বেষণে প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম করে আল্লাহ তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করবেন। এটি পথনির্দেশনা খোঁজার ক্ষেত্রে আন্তরিক প্রচেষ্টার গুরুত্বের উপর জোর দেয়। আয়াতটি  এটা পারস্পরিক সম্পর্কের ২টি  দিক নির্দেশ করে: ১) নির্দেশনা অন্বেষণের জন্য আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা আল্লাহর অটল সমর্থন এবং নির্দেশনা দ্বারা পূরণ করা হয়; ২) যা ন্যায়পরায়ণতা এবং ভাল কাজের পথকে আলোকিত করে। প্রচেষ্টা এবং পথনির্দেশনার মধ্যে এই সম্পর্কটি মানুষের ইচ্ছা এবং ঐশ্বরিক সাহায্যের একটি সমীকরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যেখানে আমাদের জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার অন্বেষণ আমাদের ইচ্ছার পরিপূর্ণতা সম্পূর্ণ করে। আর আমাদের পথ খোঁজার এবং বেছে নেওয়ার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত স্বাধীনতার প্রমাণ বহন করে।

সকল সৃষ্টিরই পথনির্দেশনা বা হেদায়েত পাওয়ার অধিকার রয়েছে। পথনির্দেশনার অধিকার একটি “হক্ক” বা অধিকার যা আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টিকে দিয়েছেন। আমরা মানুষ, আমাদের উদ্দেশ্য, ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা অনুযায়ী পথনির্দেশনা লাভ করি। পথনির্দেশের অধিকার আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে এবং কীভাবে জীবন পরিচালিত করতে হয় সে সম্পর্কে ধারণা দেয়। মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য পথনির্দেশনা হিসাবে আল্লাহ আল-কোরআন অবতীর্ণ করেছেন পবিত্র “কিতাব” হিসাবে। আল-কোরআন সার্বজনীন ও সবমানুষের পথনির্দেশনা ও মুক্তির সনদ হিসাবে আবির্ভূত আছে। আল-কোরআন ছাড়াও মানুষকে আল্লাহ তার সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য ও কার্যক্রমের মাধ্যমে এবং মানুষের চিন্তার মধ্যে পথনির্দেশনা দেন। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্য ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও আল্লাহর পথনির্দেশনা পেতে পারে। একজন মুসলিম তার দৈনন্দিন জীবনে প্রতি প্রার্থনার   – সূরা ফাতিহা ১:৬ “আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন” – মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে পথনির্দেশনা চান। এই পথনির্দেশনা কোনো এককালীন বিষয় নয়, বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যে আমাদের জীবনে সর্বদা পথনির্দেশনার দরকার রয়েছে।

২.৩ স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার মধ্যে সম্পর্ক

উপরোক্ত আলোচনার বর্ণনা থেকে স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার মধ্যে সম্পর্কের ধারণা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। উভয় ধারণাই একেঅপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত। মানব মর্যাদার মৌলিক অন্তর্নিহিত প্রয়োজনীয়তাকে প্রতিফলিত করে এই স্বাধীনতা ও পথনির্দেশনা।

স্বাধীনতা ব্যক্তিদের তাদের জীবন যাপনের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত যা তারা উপযুক্ত মনে করে, তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত এবং পছন্দগুলি গ্রহণ করে, যদি সেটা অন্যদের ক্ষতি না করে। পূর্ণাঙ্গ অর্থে স্বাধীনতা – ধর্ম, কর্ম, মেলামেশা এবং চলাচল সহ বিভিন্ন স্বাধীনতাকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা ব্যক্তি ও সমাজের বিকাশের জন্য অপরিহার্য।  পথনির্দেশনা মানুষের জ্ঞাত সিদ্ধান্ত নিতে এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। যদিও স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন এবং পছন্দ বেছে নেওয়ার ক্ষমতার উপর জোর দেয়, পথনির্দেশনা সেই পছন্দগুলিকে বুদ্ধিমানের সাথে এবং কার্যকরভাবে করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং কাঠামো প্রদান করে।

এই দুটি ধারণার মধ্যে সম্পর্ক স্বাধীনতার ভারসাম্য এবং সেই স্বাধীনতার জ্ঞাত অনুশীলনের মধ্যে রয়েছে। পথনির্দেশনা ছাড়া স্বাধীনতা এমন পছন্দের দিকে নিয়ে যেতে পারে যা অন্যায় এবং ক্ষতিকারক। অন্যদিকে স্বাধীনতা ব্যতীত পথনির্দেশিকা ব্যক্তির বিকাশ ও মর্যদার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং স্বাধীনতার নৈতিক দিক বোঝার জন্য পথনির্দশনা অপরিহার্য এবং ব্যক্তির পরিপূর্ণ মর্যদার জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য। এইভাবে, সর্বোত্তম মানব এবং সামাজিক উন্নয়য়েনে স্বাধীনতাকে দায়িত্বের সাথে প্রয়োগ করার জন্য স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনা উভয়ই প্রয়োজন।

২.৪ স্বাধীনতা এবং নির্দেশনার অধিকার বলতে তাহলে আমরা কি বুঝি?

স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করে যে ব্যক্তিদের তাদের স্বায়ত্তশাসন প্রকাশ করার এবং তাদের জীবন সম্পর্কে পছন্দ করার ক্ষমতা রয়েছে। কোরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্ত পথনির্দেশনার অধিকার নির্দেশ করে যে পথনির্দেশিকা হল একটি ঐশ্বরিক বিধান যা মানুষ সহ সমস্ত সৃষ্টিকে দেওয়া হয়েছে; তাদের অস্তিত্বকে পরিচালিত করার এবং তাদের জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য। সুতরাং, স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার নির্দেশ করে যে ব্যক্তিদের কেবল পছন্দ করার স্বাধীনতাই নয় বরং সেই পছন্দগুলি বিজ্ঞ ও নৈতিকতার সাথে করার জন্য সঠিক দিকনির্দেশনার পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ব্যক্তির স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে, স্বাধীনতার অনুশীলন নৈতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিশ্চিত করার জন্য পথনির্দেশনা অপরিহার্য।

স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার – মানুষের জীবনের একটি মৌলিক দিক তুলে ধরে: মানুষের নিজের পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা এবং সেই পছন্দগুলি করার ক্ষেত্রে পথনির্দেশনার পাওয়ার অধিকার আছে। স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার স্বায়ত্তশাসন এবং ব্যক্তিগত বিকাশ ও উন্নয়নের একটি কাঠামো প্রদান করে। এটা নিশ্চিত করে যে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও নৈতিকতা ব্যক্তি ও সমাজ উভয় কল্যাণের সাথে সংযুক্ত। মানবিক সম্ভাবনার পূর্ণ উপলব্ধি এবং ন্যায়পরায়ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য স্বাধীনতা ও পথনির্দেশনার অধিকার অপরিহার্য।

২.৫ ইসলামের দৃষ্টিকোণে স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার

সূরা আল-বাকারা (২:২৫৬):

“ধর্ম গ্রহণে কোন জবরদস্তি থাকবে না। ভুল থেকে সঠিক পথ স্পষ্ট হয়ে গেছে।”

এই আয়াতটি একজন ব্যক্তির ধর্ম গ্রহণের স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসনের চিন্তাকে তুলে ধরে, যা স্বাধীনতা ও পথনির্দেশনার অধিকারের নীতিগুলির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। এই আয়াতটি দ্ব্যর্থহীনভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতিকে জোরদার করে এবং বিশ্বাসের জোরপূর্বক আরোপকে প্রত্যাখ্যান করে। “কোনও বাধ্যবাধকতার অধীনে থাকবে না” বাক্যাংশটি এই ধারণাটিকে বোঝায় যে ব্যক্তিদের একটি নির্দিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা উচিত নয়। একটি ধর্মীয় বিশ্বাস গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে।

আয়াতের শেষের অংশ, “সঠিক পথ ভুল থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে,” পথনির্দেশনার ধারণাকে তুলে ধরে। আয়াতটি অন্যের বিশ্বাস এবং অভিব্যক্তিকে সম্মান করার দায়িত্ব সহ সঠিক এবং ভুলের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করে। এটি পরামর্শ দেয় যে যদিও ব্যক্তিদের তাদের ধর্ম বা পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে, একই সাথে সেখানে একটি ঐশ্বরিক পথনির্দেশনা রয়েছে যা সঠিক এবং ভুলের মধ্যে পার্থক্য করে।  পথনির্দেশনা সকলের জন্য উম্মুক্ত করা হয়েছে, যাতে মানুষ তাদের আধ্যাত্মিক যাত্রার বিষয়ে জ্ঞাত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়।

এই আয়াতটি স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে যে সত্যিকারের বিশ্বাসের স্বাধীনতা রয়েছে স্পষ্ট নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে। এটি নিশ্চিত করে যে পথনির্দেশনা স্বাধীনতার উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে না।  বরং, এটিকে পরিপূরক করে যার মধ্যে জ্ঞাত এবং বিবেকপূর্ণ পছন্দগুলি স্বাধীনভাবে করা যেতে পারে। এই আয়াতটি এমন একটি বিশ্বদর্শনকে সমর্থন করে যেখানে স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিটি স্বায়ত্তশাসন, উদ্দেশ্য এবং অর্থপূর্ণ পছন্দের জীবনকে লালন করার জন্য পথনির্দেশনা অপরিহার্য। 

সূরা আল-ইসরা (১৭:৭০):

 “নিশ্চয়ই, আমরা আদম সন্তানদের মর্যাদা দিয়েছি, তাদের স্থলে ও সমুদ্রে বহন করেছি, তাদের উত্তম ও বৈধ রিযিক দিয়েছি এবং আমাদের অনেক সৃষ্টির উপরে তাদের মর্যাদা দিয়েছি।” 

এই আয়াতে আল্লাহ আদম সন্তানদের যে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন, মানুষের অন্তর্নিহিত মূল্য এবং সম্মানকে তুলে ধরেন। এই আয়াতটি মানবিক মূল্যের ঐশ্বরিক স্বীকৃতি এবং মানবতাকে প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাগুলিকে গুরুত্ব দেয়। আদম সন্তানদের মর্যাদা স্বাধীনতার অধিকারের ভিত্তি হিসাবে বোঝা যায়। মানুষকে অন্য অনেক প্রাণীর উপরে উন্নীত করে এবং পৃথিবী জুড়ে তাদের চলাচল সহজতর করে, আল্লাহ মানবজাতিকে পৃথিবী অন্বেষণ, বসবাস এবং পরিচালনার স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। এই স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ যা মানুষকে দেওয়া হয়েছে, যা তাদেরকে জীবন, চলাফেরা এবং ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে পছন্দ করতে দেয় যা ভাল এবং আইনসম্মত। “ভাল এবং আইনানুগ বিধান” এর বিধানটি প্রস্তাব করে যে স্বাধীনতা নৈতিক পছন্দ করার দায়িত্বের সাথে আসে।

বহু সৃষ্টির উপরে উন্নীত হওয়ার সৌভাগ্য এবং যা কিছু ভালো ও বৈধ তা পথনির্দেশনা পাওয়ার অধিকারকে তুলে ধরে। এই পথনির্দেশনা আল্লাহর অনুগ্রহ যা মানুষকে জীবনের সঠিক পথ বুঝতে, নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং জ্ঞান ও ধার্মিকতার সাথে তাদের পার্থিব ভূমিকা পালন করতে সক্ষম করে। বৈধ বিধানের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় যে পথনির্দেশিকা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক মাত্রাই নয় বরং জীবনের ব্যবহারিক দিকগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এইভাবে, পথনির্দেশের অধিকারটি ঐশ্বরিক ইচ্ছা এবং প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন যাপন করার জন্য মানবজাতিকে নির্দেশ করে।

এই আলোকে, সূরা আল-ইসরা (১৭:৭০) আল্লাহর পক্ষ থেকে আন্তঃসম্পর্কিত বিষয় হিসাবে স্বাধীনতার অধিকার এবং পথনির্দেশনার সারমর্মকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই আয়াতটি এই বিশ্বাসকে পুনর্ব্যক্ত করে যে মানুষ পছন্দ করার স্বাধীনতা এবং সেই পছন্দগুলিকে বিজ্ঞতার সাথে করার জন্য ঐশ্বরিক দিকনির্দেশনার প্রয়োজন আছে। এই অধিকার মানুষের সমৃদ্ধ, স্বায়ত্তশাসন এবং ঐশ্বরিক ইচ্ছার আনুগত্যের মধ্যে একটি সম্প্রীতির ভারসাম্য প্রতিফলিত করে।

সূরা আল-হুজুরাত (৪৯:১৩):

“হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধার্মিক। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও অবহিত।”

আয়াতটি মানব বৈচিত্র্য, সমতা এবং প্রতিটি ব্যক্তির অন্তর্নিহিত মর্যাদা সম্পর্কে একটি গভীর বার্তা প্রদান করে।  এটি ইসলামী কাঠামোর মধ্যে স্বাধীনতার অধিকার এবং পথনির্দেশনার ধারণাগুলি বোঝার জন্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই আয়াতটি পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্ট এবং বিভিন্ন জাতি ও উপজাতিতে সংগঠিত সকল মানুষের বৈচিত্র্য ও সমতাকে বর্ণনা করে স্বাধীনতার অধিকারের ওপর জোর দেয়। এই বৈচিত্র্য বিভাজনের উদ্দেশ্যে নয় বরং ব্যক্তিদের আত্মপ্রকাশ ও তার  স্বীকৃতি বোঝার জন্য। এটি বোঝায় যে প্রতিটি ব্যক্তির বৃহত্তর মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধগুলি বেঁচে থাকার স্বাধীনতা রয়েছে। এখানে স্বাধীনতার অধিকার প্রকাশ পায় নিজের পরিচয়, বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রকাশের স্বাধীনতায়, যা একটি সমাজকে উৎকর্ষিত করে। মানুষের সত্যিকারের আভিজাত্য এবং সম্মান – জাতি, লিঙ্গ, বংশ দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং তার ধার্মিকতা এবং নৈতিক আচরণ দ্বারা নির্ধারিত হয়। এখানে ব্যক্তিগত চিন্তা চেতনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কুসংস্কারের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে ধার্মিকতার দিকে নিজের পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতার উপর জোর দেয়া হয়েছে।

আয়াতটি পথনির্দেশনার অধিকারকেও স্পর্শ করে আল্লাহর নির্দশনার মাধ্যমে যে মানবতার বৈচিত্র্য তৈরী হয় তা থেকে একে অপরের কাছ থেকে শেখার প্রয়োজন আছে।  মানুষ যাতে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ঐশ্বরিক সৃষ্টি ও পথনির্দেশনার বিভিন্ন রূপ বুঝতে পারে। এই পথনির্দেশিকা শুধুমাত্র ধর্মীয় নির্দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং মানবজাতির বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত বিস্তৃত জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করে। আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিই সবচেয়ে ধার্মিক, অর্থাৎ যার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক অনেক গভীর এবং যে আল্লাহর পথনির্দশনায় জীবন পরিচালিত করে। এই ধারণাটি সমস্ত মানুষের জন্য প্রদত্ত ঐশ্বরিক পথনির্দেশনাকে তুলে ধরে, যা তাদের আভিজাত্য এবং মূল্যের প্রকৃত মাপকাঠি হিসাবে আল্লাহর পথে পরিচালিত হওয়াকে বুঝায়। “নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও অবহিত” হিসাবে আল্লাহকে স্বীকার করা এই যে ঐশ্বরিক দিকনির্দেশনা মানব পরিস্থিতির অসীম বৈচিত্র্যের জন্য তৈরি করা হয়েছে। পথনির্দেশনার এই দিকটি হল ঐশ্বরিক উদ্ঘাটন এবং মানব বৈচিত্র্যের সমৃদ্ধির মাধ্যমে একজনের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে উন্নত করা।

সূরা আল-হুজুরাতে (৪৯:১৩), স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার ধারণাকে একত্রিত করে যা মানব বৈচিত্র্যকে একটি ঐশ্বরিক উপহার হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। যার অর্থ আমাদের সম্মিলিত জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাকে উন্নীত করা। আয়াতটি এমন একটি সমাজের পক্ষে সমর্থন করে যেখানে ব্যক্তিরা তাদের পরিচয় এবং বিশ্বাস প্রকাশ করার জন্য তাদের স্বাধীনতা প্রয়োগ করে। পাশাপাশি বিভিন্ন চিন্তাভাবনা এবং অভিব্যক্তির মধ্যে বৈচিত্র্যের আবিষ্কার এবং উপলব্ধির মাধ্যমে প্রদত্ত পথনির্দেশনা বুঝতে পারে। আভিজাত্যের মাপকাঠি হিসাবে ধার্মিকতার উপর জোর দেওয়া এটা পরিষ্কার করে যে সত্য স্বাধীনতার মধ্যে ধার্মিকতার জন্য সংগ্রাম করার নৈতিক দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত। আয়াতটি এমন একটি জগতের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে যেখানে বিভিন্ন মানবিক অভিজ্ঞতা এবং ঐশ্বরিক জ্ঞান সম্মিলিতভাবে ব্যক্তিদেরকে ধার্মিকতা, জ্ঞান এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার সাথে জীবনযাপন করতে পরিচালিত করে।

২.৬ স্বাধীনতা ও পথনির্দেশনার অধিকারের কাঠামোতে ইসলামের অনৈতিকতার বিশ্লেষণ

পবিত্র কোরআনে “ফাহিশা” শব্দ দিয়ে গুরুতর পাপ বা অনৈতিকতা, অশ্লীলতাকে বোঝানো হয়েছে। এটি অন্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া, অবৈধ যৌন মিলন সহ নৈতিক লঙ্ঘন এবং অশ্লীল কাজের ধারণার সাথে যুক্ত। এই শব্দটি এমন কাজগুলিকে উল্লেখ্য করতে ব্যবহৃত হয়েছে যেগুলি গুরুতরভাবে অন্যায় ও অশ্লীল। এই কাজগুলো ব্যক্তি এবং সামাজিক নৈতিকতা বজায় রাখার জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে করা হয়। এই কাজগুলি বিভিন্ন সূরাতে উল্লেখ করা হয়েছে, নৈতিক আচরণের গুরুত্বের উপর জোর দেওয়া জন্য। সামাজিক সম্প্রীতি এবং ব্যক্তিগত বিশুদ্ধতাকে ব্যাহত করে এমন কাজগুলি এড়িয়ে চলার জন্য। কোরআন এইসব আচরণের বিরুদ্ধে উপদেশ দেয়, ঐশ্বরিক নির্দেশনা এবং নৈতিক নীতি অনুসারে জীবনযাপনের পক্ষে পরামর্শ দেয়।

ফাহিশা সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতগুলিকে স্বাধীনতার অধিকার এবং পথনির্দেশনার কাঠামোর মধ্যে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা যায়। আমরা ব্যাখ্যা করব কিভাবে ঐশ্বরিক পথনির্দেশনা নৈতিকভাবে প্রশংসনীয় পথের দিকে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে পরিচালিত করে। কোরআনের আয়াতগুলি ফাহিশাকে কেবল ক্ষতিকারক বা অশোভন বলে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সেগুলো ব্যক্তিদের ত্যাগ করার নির্দেশিকা হিসাবেও কাজ করেছে।  যা মানুষের ব্যক্তিগত বিকাশ এবং সমাজের কল্যাণে  ইতিবাচকভাবে অবদান রাখার নসিহত হিসেবে এসেছে। প্রত্যেক অনৈতিকতার মূল হচ্ছে অন্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া বা তার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা।  চলুন পবিত্র কোরআনের এই বিষয়ের কিছু আয়াত নিয়ে পর্যালোচনা করি –

আল-আরাফ (৭:৩৩)

“বলুন, ‘আমার পালনকর্তা কেবল অশ্লীল কাজগুলিকে হারাম করেছেন – যা প্রকাশ্য এবং যা গোপন – এবং পাপ এবং হকের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে শরীক করা। যার জন্য তিনি প্রমাণ নাযিল করেননি এবং তোমরা আল্লাহর সম্পর্কে এমন কথা বলো যা তোমরা জানো না।”

“স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার” এর কাঠামোতে, সূরা আল-আরাফ (৭:৩৩) মানব স্বাধীনতার অনুশীলনের জন্য ঐশ্বরিক পথনির্দেশনা দ্বারা নির্ধারিত সীমানার উপর জোর দেয়া হয়েছে। এই আয়াতটি প্রকাশ্য ও গোপনে অনৈতিকতা থেকে শুরু করে পাপ, অন্যের অধিকারের বিরুদ্ধে লঙ্ঘন, প্রমান ব্যতীত আল্লাহর সাথে অংশীদার করা এবং আল্লাহ সম্পর্কে ভিত্তিহীন বিবৃতি প্রদানের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা  দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলি নৈতিক নির্দেশিকা হিসাবে কাজ করে যা নিশ্চিত করে যে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অনুশীলন নিজের বা অন্যদের ক্ষতি বা অবিচারের না যায়। এটি জ্ঞান এবং ঐশ্বরিক আদেশের প্রতি শ্রদ্ধার দ্বারা পরিচালিত, অবহিত এবং সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্বকে বোঝায়। আয়াতটি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্যের পক্ষে পরামর্শ দেয়। এখানে উল্লেখ করে যে, প্রকৃত স্বাধীনতা ঐশ্বরিক নির্দেশনার কাঠামোর মধ্যে রাখা, যার লক্ষ্য ক্ষতিকারক কর্মের পরিণতি থেকে ব্যক্তি এবং সমাজকে রক্ষা করা।

আল-ইসরা (১৭:৩২): 

“এবং অবৈধ যৌন মিলনের কাছে যেও না। প্রকৃতপক্ষে, এটি একটি অনৈতিকতা এবং একটি উপায় হিসাবে খারাপ।”

কুরআন থেকে সূরা আল-ইসরা (১৭:৩২) “স্বাধীনতার অধিকার এবং পথনির্দেশনার” থিমের অধীনে নৈতিক আচরণের সীমানার মধ্যে স্বাধীনতা অনুশীলনের গুরুত্বের উপর জোর দেয়। এটি বিশেষভাবে অবৈধ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার বিরুদ্ধে পরামর্শ দেয়, এই ধরনের আচরণকে শুধুমাত্র একটি নৈতিক লঙ্ঘন নয় বরং ধার্মিক পথ থেকে বিচ্যুতি হিসাবে চিহ্নিত করে। মানব সমাজে পুরুষ ও নারীর বৈধ সম্পর্ক, বংশ বিস্তার, পারিবারিক ও সামাজিক ভারসাম্য ব্যাহত না হয় তার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এখানে একজনের স্বাধীনতা অন্যের অধিকার, সামাজিক শৃঙ্খলা এবং মূল্যবোধের উপর লঙ্ঘন না করে তা নিশ্চিত করার আদেশ দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশ ব্যক্তিগত মর্যাদা, সামাজিক নিয়ম এবং ঐশ্বরিক আদেশগুলিকে সমর্থন করে। এটি এই বিশ্বাসের উপর জোর দেয় যে সত্যিকারের স্বাধীনতার মধ্যে নৈতিক নীতি এবং সামষ্টিক কল্যাণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত। 

আল আরাফ (৭:২৮):

“এবং যখন তারা অশ্লীল বা অনৈতিক কাজ করে, তখন বলে, “আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে তা করতে দেখেছি এবং আল্লাহ আমাদেরকে তা করার আদেশ দিয়েছেন।” বলুন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ অনৈতিক কাজের আদেশ দেন না। তোমরা কি আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বল যা তোমরা জানো না?

সূরা আল-আরাফ (৭:২৮) পূর্বপুরুষ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মাঝে অনৈতিক কাজের ন্যায্যতার যুক্তি হিসাবে আল্লাহর আদেশ আছে বলে দাবি করাকে মিথ্যা বলে আল্লাহ দ্যার্থহীনভাবে ঘোষণা দিয়েছেন। “স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার” এর দৃষ্টিকোণে, এই আয়াতটি স্বাধীনতার অনুশীলনে ব্যক্তিগত দায়িত্ব এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার গুরুত্বের উপর জোর দেয়। এটি ব্যক্তিদেরকে নৈতিক নীতির বিরোধিতাকারী চিরচারিত অভ্যাসগুলি অনুসরণ করার পরিবর্তে ঐশ্বরিক নির্দেশনার সত্যকে উপলব্ধি করার আহ্বান জানায়। এটি একজনের ক্রিয়াকলাপের একটি জ্ঞাত বোঝার এবং অনৈতিকতার জন্য ভিত্তিহীন ন্যায্যতা প্রত্যাখ্যান করার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। প্রকৃত জ্ঞান এবং ধার্মিকতার দ্বারা পরিচালিত জীবনের পক্ষে সমর্থন করে।

আন-নূর (২৪:১৯): 

“নিশ্চয়ই যারা পছন্দ করে যে, যারা ঈমান এনেছে তাদের মধ্যে অনৈতিকতা ছড়িয়ে পড়ুক [বা প্রচার করা হোক] তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। “

সূরা আন-নূর (২৪:১৯) “স্বাধীনতা এবং নির্দেশনার অধিকার” এর কাঠামোতে, এই আয়াতটি একটি কঠোর অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে যে, স্বাধীনতা নিজের এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বের সাথে আসে। অনৈতিকতার প্রচারে আনন্দ করার বিরুদ্ধে সতর্কতা একটি নির্দেশক নীতিকে তুলে ধরে: সামাজিক নৈতিকতা বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে দুর্বল করার জন্য সত্যিকারের স্বাধীনতার অপব্যবহার করা উচিত নয়। যারা অনৈতিকতার প্রচারে বিশ্বাসীদের দুর্বল করে আনন্দ পায় তাদের এই জীবন এবং পরকাল উভয় ক্ষেত্রেই খারাপ পরিণতি রয়েছে। এখানে বিশ্বাসীদের মধ্যে অনৈতিকতা ছড়ানোর পরিণতি হিসাবে সতর্ক করে দিয়ে স্বাধীনতার অনুশীলনে দায়বদ্ধতার উপর জোর দেওয়া। এটি নৈতিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখে এবং সাম্প্রদায়িক কাঠামোতে ইতিবাচকভাবে অবদান রাখে এমন উপায়ে একজনের স্বাধীনতা ব্যবহার করার গুরুত্বকে বোঝায়। 

আল ইমরান (৩:১৩৫):

 ” যখন তারা অনৈতিক কাজ করে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করে, তখন আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে – এবং আল্লাহ ছাড়া কে পাপ ক্ষমা করতে পারে? – এবং তারা যা করেছে তাতে অবিচল থাকে না যখন তারা জানে। “

এই আয়াতটি ব্যক্ত করে যে মানুষ ভুল করতে পারে এবং অনৈতিক (ফাহিশাহ) কাজ করতে পারে, তবে এটি আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে মুক্তির সম্ভবনা আছে। “স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার” এর কাঠামোতে একটি স্বাধীন সিদ্ধান্তের ফলে কোনো ভুল করলে, সেটা অবিরাম না করে, ভুল স্বীকার করে আল্লাহর স্মরণ করার মাধ্যমে ভুলের ক্ষমা ও সঠিক পথের নির্দেশ পাওয়া যেতে পারে। এখানে সচেতনতা অর্জনের পরে অন্যায় কাজগুলিতে অবিরত না থাকার উপর জোর দেওয়া নির্দেশিক দিকটি চিত্রিত করে। এখানে স্বাধীনতা একটি নৈতিক কাঠামোর মধ্যে ব্যবহার করা যা ব্যক্তিগত উন্নতি, জবাবদিহিতা এবং ধার্মিকতার ক্রমাগত অনুসরণকে উত্সাহিত করে। এটি মানুষের কার্যকলাপ, ঐশ্বরিক ক্ষমা এবং নৈতিক জীবনযাপনের অন্বেষণের মধ্যে একটি গতিশীল সম্পর্ককে প্রতিফলিত করে। ভুলগুলি সংশোধন করে এবং ঐশ্বরিক নির্দেশনার সাথে মানুষের জীবনের কার্যক্রমকে সারিবদ্ধ করার একটি পথ প্রস্তাব করে।

২.৭ অধিকারের সাথে যুক্ত কর্তব্য

যেমনটি আমরা শুরুতে আলোচনা করেছি, “হক্ক” আমাদের অধিকার দেয় এবং একই সাথে, যখন আমরা অন্যের “হক্ক” এর মুখোমুখি হই তখন এটি আমাদের জন্য কর্তব্য এবং দায়িত্বও তৈরি করে। এভাবে “হক্ক” অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে দ্বৈততা তৈরি হয়। অধিকারের সাথে সর্বদা দুটি স্তরের কর্তব্য থাকে – প্রথম স্তরটি স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য যিনি অধিকার দিয়েছেন এবং দ্বিতীয় স্তরটি সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য। স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনা আমাদের একটি অধিকার। এই অধিকারের সাথে সম্পর্কিত কর্তব্যগুলি স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমৃদ্ধিকে বজায় রাখে ও বিকাশ করে। স্বাধীনতা ও নির্দেশনার অধিকারের কর্তব্য ও দায়িত্ব হল-

২.৭.১ সর্বজ্ঞানীর প্রতি কর্তব্য: ঐশ্বরিক জ্ঞানের সন্ধান করা

পথনির্দেশের বিশেষ অধিকারটি চূড়ান্ত পথপ্রদর্শক, সর্বজ্ঞানী আল্লাহর কাছ থেকে জ্ঞান অন্বেষণ করার একটি অন্তর্নিহিত দায়িত্ব বহন করে। ঐশ্বরিক জ্ঞান অন্বেষণ করার কাজটিকে একটি অঙ্গীকার, যা স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অন্তর্নিহিত অধিকার থেকে উদ্ভূত হয়। এই সাধনা শুধুমাত্র স্বতন্ত্র ধার্মিকতার একটি কাজ নয় বরং নিজের প্রতি ন্যায়বিচারও। সর্বজ্ঞানীর পক্ষ থেকে পথনির্দেশনা যেটা প্রজ্ঞার মূল ও অন্তহীন উৎস সেটা পাওয়ার চেষ্টা করা নৈতিক মূল্যবোধের অংশ। এইভাবে স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার একটি গভীর কর্তব্যের জন্ম দেয়: সক্রিয়ভাবে আল্লাহর কাছ থেকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান অন্বেষণ করা, তাকে চূড়ান্ত গাইড এবং সমস্ত জ্ঞানের উত্স হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া। 

সূরা আল-আনকাবুত (২৯:৪৫): 

[হে মুহাম্মাদ], আপনার প্রতি কিতাব থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা পাঠ করেন এবং সালাত কায়েম করেন। নিঃসন্দেহে নামায অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে এবং আল্লাহর স্মরণ সবচেয়ে বড়। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা জানেন।

সূরা আল-আনকাবুতের (২৯:৪৫) আয়াতটি স্বাধীনতার অধিকার ও পথনির্দেশনার কাঠামোর মধ্যে আল্লাহর প্রতি কর্তব্যকে উপস্থাপন করে। এটি নবী মুহাম্মাদ (সা:) কে কিতাবে যা নাযিল করা হয়েছে তা পাঠ করার নির্দেশ দেয়, কোরআনকে উল্লেখ করে এবং সালাত কায়েম করতে বলে। এই কাজগুলি ব্যক্তিদের জন্য স্বর্গীয় নির্দেশনা এবং প্রজ্ঞার সাথে নিজেদের জীবন পরিচালনার গুরুত্বকে তুলে ধরে। কোরআন তেলাওয়াত ও পাঠ করে, এবং জীবনে এর শিক্ষার প্রতিফলন করে, নৈতিক নীতিগুলির গভীর উপলব্ধি সৃষ্টি ও বৃদ্ধির তাগিদ করা হয়েছে। প্রার্থনা আল্লাহর সাথে আধ্যাত্মিক সংযোগ এবং যোগাযোগের একটি মাধ্যম হিসাবে কাজ করে, যা ব্যক্তিদের তাদের দৈনন্দিন জীবনে নির্দেশনা এবং সমর্থনের অনুভূতিকে শক্তিশালী করে।

অধিকন্তু, আয়াতটি তুলে ধরে যে প্রার্থনা অনৈতিকতা এবং অন্যায় কাজ করা থেকে মানুষকে বিরত রাখে। স্বাধীনতা ও পথনির্দেশনার অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রার্থনা মননশীলতা, নম্রতা এবং আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করে অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে একটি সুরক্ষা হিসাবে কাজ করে। প্রার্থনার মাধ্যমে, ব্যক্তিদের তাদের নৈতিক দায়িত্ব এবং অন্যদের সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়ায় নৈতিক নীতিগুলি বজায় রাখার গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়।

এই আয়াতে আল্লাহর স্মরণের মাহাত্ম্যের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। এই বিস্তৃত ধারণাটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মননশীলতা, কৃতজ্ঞতা এবং ঐশ্বরিক উপস্থিতির সচেতনতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। স্বাধীনতা এবং নির্দেশনার অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে, আল্লাহর স্মরণ পথনির্দেশের একটি ধ্রুবক উত্স হিসাবে কাজ করে। এটি ব্যক্তিদের আল্লাহর উপর তাদের নির্ভরশীলতা এবং মানব ভাগ্য গঠনে তাঁর সার্বভৌমত্ব এবং প্রজ্ঞাকে স্বীকার করে। এটি সমস্ত বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশনা অন্বেষণ করা মানুষের কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

সবশেষে, আয়াতটি তুলে ধরে যে আল্লাহ জানেন ব্যক্তিরা কী করে। এটি ঐশ্বরিক সর্বজ্ঞতা এবং সর্বব্যাপীতার একটি অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে। “আল্লাহ জানেন” এ কথা স্মরণ করে মানুষ যেন তার আচরণে আন্তরিকতা, সততা এবং জবাবদিহিতার গুরুত্ব দেয়। মানুষের কর্ম সম্পর্কে আল্লাহর জ্ঞাত এই ধারণাটিকে শক্তিশালী করে যে প্রকৃত স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসন ঐশ্বরিক নির্দেশনা এবং নৈতিক দায়িত্বের কাঠামোর মধ্যে প্রয়োগ করা উচিত। এটি ব্যক্তিদের তাদের পছন্দ এবং আচরণকে ধার্মিকতা এবং সততার নীতির সাথে সম্পৃক্ত করতে উত্সাহিত করে।

আমরা এ বিষয়ে জোর দেই যে স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকারের অধীনে আমাদের কর্তব্যগুলি অধিকারের সাথে পরস্পর সংযুক্ত। স্বাধীন পথ বাছাই ও পথ খোঁজার স্বাধীনতা কোন দিকনির্দেশনা ছাড়া নয়। এটি ঐশ্বরিক জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত হয় যা আমাদের চিন্তার সমৃদ্ধ করে ও পথের দিকনির্দশনা দেয় স্বাধীনভাবে চলার জন্যে। সূরা আল-আনকাবুত (২৯:৪৫) আল্লাহর প্রতি কর্তব্যের উপর জোর দেয়। এটি কুরআন তেলাওয়াত, প্রার্থনা এবং আল্লাহর স্মরণকে অপরিহার্য অনুশীলন হিসাবে তুলে ধরে। যা নৈতিক সততাকে লালন করে ব্যক্তি এবং তার সৃষ্টিকর্তার মধ্যে বন্ধনকে আরও গভীর করে। এটি ব্যক্তিদেরকে আল্লাহর কাছে তাদের জবাবদিহিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা অন্বেষণের বাধ্যবাধকতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা আল্লাহর কাছ থেকে যে দিকনির্দেশনা পাই তা শুধু আমাদের স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধতা নয়। বরং এটি আমাদের জ্ঞান এবং বোঝার অন্বেষণে স্পষ্টতা এবং উদ্দেশ্য প্রদান করে। এইভাবে, ঐশ্বরিক জ্ঞান অন্বেষণ করার কর্তব্য স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রতিফলন। এই কর্তব্য গুলি পথপ্রদর্শক হিসাবে আল্লাহর ভূমিকার নিছক স্বীকৃতির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখেনা। বরং এই কর্তব্য গুলি আমাদের নীতি ও জ্ঞানের জন্য সর্বজ্ঞানীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার একটি ইচ্ছাকৃত এবং আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রতিফলন। 

কর্তব্যের সাথে স্বাধীনতার অনুশীলন, সর্বজ্ঞানীর দিকনির্দেশনায় নৈতিকতা বোঝার সন্ধান, শেখার এবং ব্যবহারের একটি গতিশীল যাত্রায় পরিণত করে। পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ পাঠ, প্রার্থনা, এবং স্রষ্টার স্মরণের মতো অনুশীলন আমাদের কেবল নৈতিক বাধ্যবাধকতাই পূরণ করে না বরং স্রষ্টার সাথে আমাদের সম্পর্ককে গভীর করে। পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ, বিশেষ করে আল-কোরআন পড়ে স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে পথনির্দশনা অর্জন করা যায়। তাই স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য হিসেবে প্রার্থনা, সর্বজ্ঞানীর স্মরণ ও পবিত্র গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে আমাদের জীবনকে গভীর জ্ঞান ও নির্দেশনা দিয়ে সমৃদ্ধ করে। আমাদের এই কর্তব্যগুলি স্রষ্টার অধিকার। সৃষ্টি তার স্রষ্টার কাছ থেকে নির্দেশনা চাইবে এটাই স্রষ্টার অধিকার তার সৃষ্টির উপর। অন্তিম পথপ্রদর্শক হিসাবে এটা  সর্বজ্ঞানী আল্লাহর “হক্ক” যে আমরা তার নিকট পথনির্দেশনা বা গাইডেন্স চাইবো আমাদের জীবন পরিচালনার জন্য। 

২.৭.২ মানুষের প্রতি কর্তব্য:

স্বাধীনতা ও পথনির্দেশনার অধিকার অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য সৃষ্টি করে। যখন আমরা অন্য মানুষের সংস্পর্শে আসি, তখন আমরা জানি যে পথনির্দেশনা পাওয়ার অধিকার এবং স্বাধীনতা সেই ব্যক্তিরও অধিকার বা “হক্ক”। এইভাবে, অন্য মানুষের “হক্ক” আমাদের দায়িত্ব পালনের জন্য একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। সেই মৌলিক কর্তব্য হল অন্যান্য মানুষের সিদ্ধান্ত, তাদের জীবনধারার জন্য পছন্দ এবং চিন্তা-চেতনাকে সম্মান করা, যতক্ষণ না তা অন্যদের ক্ষতি বা লঙ্ঘন করে।

যেমনটি আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে স্বাধীনতার অধিকারের অনেক দিক রয়েছে এবং এটি বিস্তৃত অনেক অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর মধ্যে রয়েছে বাক স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, পছন্দের স্বাধীনতা, মেলামেশার স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা ইত্যাদি। এই স্বাধীনতার অধিকার মানবতার প্রতি আমাদের কর্তব্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং সমর্থনের উপর জোর দেয়। এই দায়িত্বের জন্ম এই স্বীকৃতি থেকে যে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাদের জীবনের পথ চলার জন্য নির্দেশনা চাওয়ার এবং তাদের স্বাধীনতা প্রয়োগ করার সমান অধিকার আছে। আমাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে অন্যের বাকস্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, পছন্দের স্বাধীনতা, সমিতির স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা ইত্যাদিকে সম্মান করা, যদি তারা অন্য কারও অধিকার বা মঙ্গল লঙ্ঘন না করে।

এই সম্মান নিছক সহনশীলতা নয় বরং সামাজিক জীবনের ভারসাম্য ও সম্প্রীতির জন্য নৈতিকবোধ। প্রতিটি ব্যক্তিকেই এটা স্বীকার করতে হবে যে মানুষের জীবনের চলার পথ ভিন্ন হতে পারে এবং প্রতিটি যাত্রা তাদের স্বাধীন চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন। মানুষের অন্তর্নিহিত মর্যাদা এবং তাদের পথনির্দেশনার সন্ধানের পবিত্রতাকে স্বীকার করতে হবে। অতএব, অন্যদের বিশ্বাস এবং অভিব্যক্তিকে বাধা প্রদান থেকে বিরত থাকা আমাদের কর্তব্য। স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকারে ভিত্তি করে, আমাদের সহ-মানবের প্রতি একটি মৌলিক দায়িত্ব অর্পণ হয়: জীবনে চলার এবং আলোকিতকরণের দিকে তাদের যাত্রাকে সম্মান করা।

স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার আমাদের জন্য অন্যের বিশ্বাস এবং অভিব্যক্তিকে যেমন সম্মান করা শিখায়, একইভাবে নৈতিক দায়িত্ববোধ তৈরী করে যা অন্যদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে আল্লাহ সকলের জন্য চূড়ান্ত, সঠিক ও অন্তিম পথপ্রদর্শক। অন্যের উপর নিজের বিশ্বাস চাপিয়ে না দেওয়া এবং তাদের নিজস্ব উপায়ে পথনির্দেশিকা খুঁজে পাওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া। উপরন্তু, এটি স্বীকার করা যে পথনির্দেশিকা শুধুমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে আসে এবং আল্লাহ যাকে চান পথনির্দশনা দান করেন। অন্য মানুষের চিন্তা-ভাবনা এবং তাদের কার্যকলাপের প্রতিফলনের মাঝে আমাদের জন্য শিক্ষা আছে । পথনির্দেশনা চাওয়ার জন্য অন্যদের নিজস্ব পদ্ধতি এবং দায়িত্বকে সম্মান করা উচিত। এইভাবে, আমরা অন্যের পথনির্দেশিকা অধিকারকে সম্মান ও সমর্থন করার দায়িত্ব পালন করতে পারি।

আমাদের দায়িত্ব এমন একটি পরিবেশ গড়ে তোলা যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও পথনির্দেশিকা সুরক্ষিত থাকে। এর মধ্যে আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস অন্যের উপর চাপিয়ে না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এটি স্বীকার করা যে সত্যিকারের পথনির্দেশিকার পদ্ধতি হল ব্যক্তি এবং ঐশ্বরিক মধ্যে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যাত্রা। এমন স্থান তৈরি করা যেখানে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সত্য এবং ধার্মিকতার সম্মিলিত উপলব্ধি আমাদের জন্য মূল্যবান হয়। এই দায়িত্বের মধ্যে নিজেদের এবং অন্যদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়াও যে পথনির্দেশনা শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছ থেকে আসে। সমাজে নম্রতা এবং একে অপরের কাছ থেকে শেখার জন্য উন্মুক্ততাকে উত্সাহিত করা দরকার।

এইভাবে, স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার সম্মিলিত দৃষ্টিকোণ থেকে, মানবতার প্রতি আমাদের কর্তব্য সহানুভূতি, সম্মান এবং সমর্থনের সাথে কাজ করা। এমন একটি সমাজের ধারণ ও লালন করা যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে প্রকাশ করতে স্বাধীন, যতক্ষণ না সে অন্যদের ক্ষতি বা লঙ্ঘন করে। এই কর্তব্য শুধুমাত্র ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকারকে সম্মান করে না বরং একটি সৌহার্দপূর্ণ শান্তি পরিবেশে তৈরিতে অবদান রাখে। যেখানে মানুষের অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যের উপর ভিত্তি করে একটি সমৃদ্ধশালী সমাজ শক্তি, প্রজ্ঞা এবং সংবদ্ধতা বোঝার উত্স হিসাবে আবির্ভূত হয়।

২.৮ স্বাধীনতা ও পথনির্দেশনার অধিকারে রাষ্ট্রী ও সমাজের দায়িত্ব:

নৈতিক দায়িত্বের কাঠামোতে, আমাদের কর্তব্যগুলি ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতা অতিক্রম করে সমাজকে গড়ে তোলার জন্য একটি বৃহত্তর প্রতিশ্রুতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিটি ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকারকে সম্মান, সমর্থন, সংরক্ষণ, সুরক্ষা এবং লালন করে। এই দায়িত্ব একটি ন্যায়সঙ্গত এবং সহানুভূতিশীল সমাজের ভিত্তি হিসাবে স্বাধীনতা এবং ঐশ্বরিক নির্দেশনার অন্তর্নিহিত প্রকৃতির উপর জোর দেয়। নিম্নে উদাহরণ স্বরূপ সমাজ ও রাষ্ট্রের কিছু নৈতিক দাযিত্বের দিক তুলে ধরে হলো – 

২.৮.১ ঐশ্বরিক নীতি বোঝা ও সচেতনতা প্রচার করা

অস্তিত্বের সবকিছুই ঐশ্বরিক প্রক্রিয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়।  সূরা আত-ত্বহা (২০:৫০) উল্লেখ করেছি যে প্রতিটি জিনিসকে তার অস্তিত্ব দেওয়ার পরে, আল্লাহ সেই সৃষ্টির উদ্দেশ্য, দিকনির্দেশনা এবং কার্যকারিতার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে চলেছেন। এই  “পথনির্দেশ” বা হেদায়েত কোনো এককালীন বিষয় নয় বরং এটা চলমান এবং সবসময়ের জন্য। সর্বজ্ঞানীর পক্ষ থেকে পথনির্দেশনা যেটা প্রজ্ঞার মূল ও অন্তহীন উৎস সেটা পাওয়ার চেষ্টা করা নৈতিক মূল্যবোধের অংশ। আমাদের নীতি ও জ্ঞানের জন্য সর্বজ্ঞানীর সাথে সম্পর্ক  স্থাপন করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকা দরকার। স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য হিসাবে কোরআন পাঠ, প্রার্থনা, এবং সর্বজ্ঞানীর স্মরণের মাধ্যমে আমাদের জীবনকে গভীর জ্ঞান ও নির্দেশনা দিয়ে সমৃদ্ধ  করতে পারি। এ ধরণের ঐশ্বরিক নীতি ব্যক্তি জীবনে,  শিক্ষামূলক উদাহরণ তৈরী করে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে বিস্তার ও প্রচার করা উচিত। যাতে মানুষ স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পূরণের করে সৌহার্দপূর্ণ ও ভারসাম্য সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে।

২.৮.২ ঐশ্বরিক পথনির্দেশনার একটি কাঠামোর মধ্যে ব্যক্তি স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা

স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসন এবং পথনির্দেশনা অনুসরণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে নৈতিক দায়িত্বের ভিত্তি রচনা করা। এটি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যেখানে –  মানুষের বাকস্বাধীনতা, বিশ্বাসের স্বাধীনতা, পছন্দের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা ইত্যাদি সমর্থিত, সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত থাকে। একইসাথে ঐশ্বরিক জ্ঞান দ্বারা প্রদত্ত নৈতিক দিকনির্দেশনার সীমানা অনুসরণ করার জন্য ব্যক্তিদের দায়িত্বের কথা বলে। এটা পরিষ্কার করতে হবে যে, ঐশ্বরিক পথনির্দেশনা নৈতিকভাবে প্রশংসনীয় পথের দিকে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে পরিচালিত করে। সমাজে অনৈতিক, অশ্লীল ও ক্ষতিকারক কাজগুলোকে নিষিদ্ধ বা সীমিত বা সীমাবদ্ধতার মাঝে এনে এটা  নিশ্চিত করা যে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অনুশীলন অন্যদের ক্ষতি বা অবিচারের না করে। যেখানে প্রকৃত স্বাধীনতা ঐশ্বরিক নির্দেশনার কাঠামোর মধ্যে রেখে ক্ষতিকারক কর্মের পরিণতি থেকে ব্যক্তি এবং সমাজকে রক্ষা করা। এটি নৈতিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখে এবং সমাজে ইতিবাচকভাবে অবদান রাখে এমন উপায়ে একজনের স্বাধীনতা ব্যবহার করার কথা বলা। অনৈতিকতা ও অশ্লীলতা  ছড়ানোর খারাপ পরিণতি হিসাবে সতর্ক বা শাস্তির বিধান করে দিয়ে স্বাধীনতার অনুশীলনে দায়বদ্ধতার উপর জোর দেওয়া। 

২.৮.৩ বিভিন্ন পথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা

সম্মিলিত নৈতিক দায়িত্ব অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশের সৃষ্টি করা। যেখানে মানুষেরা চিন্তা-ভাবনা বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করে এমন অসংখ্য উপায়কে সম্মান সমর্থন করা। এর মধ্যে রয়েছে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেটা নিশ্চিত করা যে বিভিন্ন মতামত এবং বিশ্বাসকে সহ্য ও সন্মান করা হয়। এই স্বাধীনতা সম্মিলিত মানব অভিজ্ঞতাকে সমাজ বিনিনির্মানে সহায়তা হিসাবে দেখা ও তার প্রচার করা। এই ধরনের পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে, সমাজ এবং রাষ্ট্র একইভাবে এই নীতিটি নিশ্চিত করে যে ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মঙ্গল ও উন্নয়নের জন্য স্বাধীনতার অধিকার এবং পথনির্দেশনা অনুসরণ করা অপরিহার্য। এখানে এই অধিকারগুলিকে রক্ষা করার জন্য একটি সক্রিয় অবস্থানের জন্য আহ্বান জানানো। এমন নীতি এবং অনুশীলনের জন্য সমর্থন করা যা বৈষম্য বা জবরদস্তির ভয় ছাড়াই প্রতিটি ব্যক্তির আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক যাত্রা অন্বেষণ করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এই দায়িত্ব বিশ্বাস এবং বিশ্বাসের বিভিন্ন অভিব্যক্তির সহঅবস্থান রক্ষা করার জন্যে পরিবেশ তৈরী করা। এটি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহাবস্থানের পরিবেশকে উৎসাহিত করা এবং যেকোনো ধরনের নিপীড়ন বা ব্যক্তি স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ দ্বারা সীমাবদ্ধহীন জীবনের পথ সন্ধান করার জন্য সমস্ত ব্যক্তির অধিকারের পক্ষে সমর্থন করা।

২.৯ উপসংহার

স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকারের বিস্তারিত আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে সমাজের মধ্যে স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার একীকরণ নৈতিক দায়িত্ব এবং মানবিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। আমরা এই ধারণায় উপনীত যে সত্যিকারের স্বাধীনতায় শুধুমাত্র ব্যক্তি অধিকারে সীমিত থাকে না বরং অন্যের অধিকার ও মঙ্গলকে সমুন্নত রাখার দায়িত্বও অন্তর্ভুক্ত করে। এই অধিকারের সাথে সম্পর্কিত কর্তব্যগুলি স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমৃদ্ধিকে বজায় রাখে ও বিকাশ করে।

ইসলামী সমাজে স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকার নিয়ে আলোচনা ইসলামী দর্শনের এই দুই অধিকারের গভীর সংযোগকে তুলে ধরে। এটি বলে যে, মানব মর্যাদা এবং নৈতিকভাবে নির্দেশিত জীবনের সাধনা স্বাধীনভাবে নিজের পথ চয়ন করার অধিকার দেয়। এই দ্বৈত অধিকারের কাঠামো শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনকে সমৃদ্ধ করে না, বরং একটি সমাজকে নৈতিক সততা, পারস্পরিক সম্মান এবং সামগ্রিক কল্যাণের মূল্য দেয়। আলোচনা ইসলামের শিক্ষা এবং মূল্যবোধের সাথে ব্যক্তিগত উন্নতি এবং সমাজের অগ্রগতির সর্বোচ্চ মান অর্জনের জন্য স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগের পক্ষে সমর্থন করে।

এই অধিকারটি কোনো নিষ্ক্রিয় এনটাইটেলমেন্ট নয় বরং সর্বজ্ঞানীর সাথে একটি সক্রিয় সম্পৃক্ততা। স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য হিসেবে পবিত্র গ্রন্থ পাঠ, প্রার্থনা, সর্বজ্ঞানীর স্মরণের মাধ্যমে আমরা জীবনকে গভীর জ্ঞান ও পথনির্দেশনা দিয়ে সমৃদ্ধ করা। এই কর্তব্য আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য পূরণের আমাদের স্বাধীনতার অনুশীলন করার  একটি নৈতিক দিকরেখা দেয়। স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনা যেমন আমাদের অধিকার তাই এর সাথে সম্পৃক্ত কর্তব্যগুলি স্রষ্টার অধিকার। 

মানুষের প্রতি আমাদের মৌলিক কর্তব্য হল মানুষের জীবনধারার জন্য পছন্দ এবং চিন্তা-চেতনাকে সম্মান করা, যতক্ষণ না তা অন্যদের ক্ষতি বা লঙ্ঘন করে। এই অধিকারে মানুষের প্রতি আমাদের কর্তব্য সহানুভূতি, সম্মান এবং সমর্থনের সাথে কাজ করা। এই কর্তব্য শুধুমাত্র ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার অধিকারকে সম্মান করে না বরং একটি সৌহার্দপূর্ণ শান্তি পরিবেশে তৈরিতে অবদান রাখে। 

নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকারকে সম্মান, সমর্থিত এবং সুরক্ষিত করা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বহন করে। স্বাধীনতা এবং পথনির্দেশনার নীতিগুলি থেকে প্রাপ্ত নৈতিক দায়িত্বগুলি আমাদেরকে এমন একটি সমাজ তৈরির জন্য অনুরোধ করে যেখানে ঐশ্বরিক জ্ঞান এবং মানব স্বাধীনতা একত্রিত হয়। এটি এমন একটি সমাজ তৈরি করে যা প্রতিটি ব্যক্তির মর্যাদা এবং অধিকারকে সম্মান করে। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব ন্যায়বিচার, স্বায়ত্তশাসন, এবং চিন্তা-চেতনার বিভিন্ন পথের প্রতি সম্মান বজায় রাখার প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়ন ও প্রতিফলিত করা। এই দায়িত্ব একটি সহানুভূতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আলোকিত সম্প্রদায়কে লালন করার জন্য একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা।

Shallow Insan

We strive to break the barrier of the superficial form of thinking to understand and explain complex and interrelated designed events and systems.

Leave a Reply