গাধা থেকে কি শিক্ষা নিতে পারি : পর্ব – ১.৪

donkey

ফ্ল্যাশব্যাক – (শ্যালো ইনসান উটের কথা ভাবছে। …কিছুদূর যেতেই সে একটা গাধা দেখতে পায়  ………. )

গাধাকে দেখে শ্যালো ইনসান নিজের অজান্তেই হেসে উঠলো।

গাধা: কি, আমাকে দেখে হাসি পায়?

শ্যাই: একটু  লজ্জাবোধ নিয়ে, না না ছোট বেলায় তোমাকে নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি সেগুলো মনে হতে একটু হাসি পেল। যাই হোক, তোমার সাথে একটা গল্প শেয়ার করতে চাই।  শুনবে তুমি?

গাধা: ও আচ্ছা।  বলো, শুনি তোমার গল্পটা।

শ্যাই: 

——————————————————————————————————————————

অনেক অনেক দিন আগে হিমালয়ের পাদদেশে অচিনপুর নামে একটা দেশ ছিল। একদিন জাহাজে চড়ে এক পর্যটক সে দেশে ভ্রমণ করতে যান। পর্যটক লক্ষ্য করলেন সে দেশে নৌকা ছাড়া আর কোনো চলাচলের মাধ্যম নেই। তাই তিনি এক নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন,

পর্যটক: কি ব্যাপার এখানে নৌকা ছাড়া আর কোনো পরিবহন দেখছিনা? ব্যাপারটা কি?

মাঝি: আমাদের দেশে হিমালয়ের বরফ গলে অনেক পানি এসেছে? বিধাতার আশির্বাদ আমাদের উপর। তাই আমরা নৌকা দিয়ে সব কাজ চালায়?

পর্যটক: তো তোমরা খাওয়া দাওয়া কি করো?  ধান, চালের কি অবস্থা?

মাঝি: ধানতো পানির নিচে। দেখা যায় না। চাল আসবে কোথা থেকে?

পর্যটক: আচ্ছা, তাহলে তোমার চাষাবাদ কি করো?

মাঝি: চাষাবাদ কিভাবে হবে? সব জায়গায় পানি। লাঙ্গল সাজাই রাখছি।

পর্যটক: তাহলে তোমরা কি খাও?

মাঝি: আমরা হাইড্রোপনিক, একোয়াপনিক ইত্যাদি পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন করি।  আর যেগুলো এই পদ্ধতিতে হয় না, সেগুলো হিমালয়ের অঞ্চল থেকে আমদানি করি। 

পর্যটক: আচ্ছা! তাই নাকি? 

মাঝি: হ্যা।

পর্যটক: তোমাদের দেশে যখন কেও আইন ভঙ্গ করে, তখন তার বিচার করো কিভাবে?

মাঝি: আমরা আমাদের বিধাতার আইন অনুসরণ করি। আইন থাকে আমাদের হাতে। বিধাতার আশীর্বাদে আইনের যোজন ও বিয়োজনের কাজ আমরাই করি।

পর্যটক: তাহলে তোমার ন্যায়বিচার করো কিভাবে? মানে দাঁড়িপাল্লার কি অবস্থা?

মাঝি: দাঁড়িপাল্লা! আমাদের বিচার হচ্ছে, যে আমাদের বিধাতাকে মান্য করে ও আমাদের কথা মতো চলে, রায় থাকবে তার পক্ষে। যে আমাদের অমান্য করে চলবে তাদের জন্য কঠিন শাস্তি। এটাই ন্যায়বিচার, অচিনপুরের বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। আমাদের এখানে কোনো দাঁড়িপাল্লা নাই।

পর্যটক: তোমরা যে এভাবে সবকিছু পরিচালনা করো, তাতে অচিনপুরবাসীরা কি বলে?

মাঝি: অচিনপুরবাসীরা আর কি বলবে? তাদের তো হাটু পর্যন্ত পানি।

পর্যটক: অচিনপুরের এই অবস্থা দেখে তারা কোনো কথা বলে না?

মাঝি: না। তাদের কাছ থেকে আমরা কোনো জিনিস নিলেও তারা কিছু বলেনা। তাদের অনেকে হাতজোড় করে বলে, “আমাদের কে তোমাদের নৌকায় নিয়ে চলো”। আমাদের দয়া হলে তাদের কিছু কিছুকে আমাদের সাথে নৌকায় তুলে নেই। আরে, নৌকায় একবার উঠলেইতো সব প্রাপ্তি। এই উপলব্ধি অচিনপুরবাসীদের আছে।

তবে হ্যা, অল্প কিছু মানুষ কথা বলে, আমরা তাদেরকে নদীর উজানে নিয়ে ফেলে দেই। মাথায় বুদ্ধি ও ভালো সাঁতার জানলে তাদের কেউ কেউ বাড়ি পৌঁছাতে পারে, তবে বেশির ভাগেরই সলিল সমাধি। সব ঠান্ডা।

পর্যটক: (গা শিওরে উঠলো, ভয়ে ভয়ে বললো) পানি চলে গেলে কি হবে তোমাদের?  অচিনপুরবাসীরা কি সেটা বুঝেনা? সেটা নিয়ে কিছু বলে না?

মাঝি: আমরা তাদের এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছি। বলেছি, আমরা তাহাজ্জুদ নামাজ পরে দোয়া করি। আর আমাদের বিধাতা আমাদের কাজ কর্মে খুশি হয়ে হিমালয়ের বরফ গলিয়ে  ও নদীর উজানের সকল বাঁধ খুলে পানির ব্যবস্থা করে যাবেন। পানির কোনো অভাব হবে না। নৌকাই অচিনপুরবাসীদের ভরসা।

পর্যটক: তারা কি আশ্বস্ত হয়েছে?

মাঝি: কিছুটা। তবে আমরা তাদেরকে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। সেটাতে তারা খুব খুশি।

পর্যটক: সেটা কি রকম?

মাঝি: আমরা বলেছি, তোমাদের জন্য শিগ্রই উন্নত বিশ্ব থেকে অনেক বড় বড় বিলাসবহুল ক্রূজ জাহাজ আসবে। তোমার সেখানে থাকবা। সে সকল জাহাজে সব ধরণের খাওয়া থাকবে। তোমার ইচ্ছা মতো খাবা।  তোমাদের জন্য বিশেষ পানিও ব্যবস্থা থাকবে। যত ইচ্ছা পান করতে পারবা। আর তোমাদের বিভিন্ন ধরণের বিনোদনের জন্য থাকবে সুন্দরী-পরীরা। একেবারে স্বপ্নীল জীবন।

পর্যটক: বর্তমানের এহেন পরিস্থিতি, এতো নিদর্শন ও সংকেত থাকার পরও কি তারা এই স্বপ্ন দেখে?

মাঝি: দেখে মানে? আলবত দেখে। স্বপ্ন না দেখলে বর্তমানের অস্থিরতা দূর হবে কি করে? স্বপ্ন না দেখলে পরবর্তী প্রজন্ম কি করবে? অচিনপুরবাসীরা বোঝে দুঃখ ও কষ্টের পরে সুখ ও সমৃদ্ধি আসে। সফলতা ও উন্নতির চরম শিখরে উঠতে কিছু সময় লাগে। এতটুকু ধৈর্য্য অচিনপুরবাসীদের আছে।

——————————————————————————————————————————

গাধা: হুম। আমাকে দেখে তোমার অচিনপুরবাসীদের কথা মনে পড়লো। আর এই গল্প বলতে কি আমার কাছে এসেছো?

শ্যাই: আমি তোমার কাছে কিছু জানতে চাই।

গাধা: বলো, কি জানতে চাও?

শ্যাই: পবিত্র কোরআনে তোমার কথা কয়েকবার বলা হয়েছে। তোমার উদাহরণ দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে? আর সেখান থেকে আমাদের জন্য কি শিক্ষা আছে?

গাধা: ঠিক আছে বলবো। তার আগে তুমি বলো কোরআনে কতবার আমাকে উল্লেখ করা হয়েছে?

শ্যাই: পবিত্র কোরআনে মোট ৫ আয়াতে ৫ বার তোমার নাম উল্লেখ করা আছে – হিমার  [২:২৫৯, ১৬:৮, ৩১:১৯; ৬২:৫, ৭৪:৫০] ।

গাধা: আয়াতে আমাকে কি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা আগে বলি। তারপর তোমাদের শিক্ষা কি সেটা বলবো।

শ্যাই: ঠিক আছে।

গাধা: প্রথমে সূরা বাকারা আয়াত ২:২৫৯- 

অথবা দৃষ্টান্তস্বরূপ সেই ব্যক্তিকে দেখো যে এমন একটি লোকালয় অতিক্রম করেছিল, যার গৃহের ছাদগুলো উপুড় হয়ে পড়েছিল। সে বললোঃ এই ধ্বংসপ্রাপ্ত জনবসতি, একে আল্লাহ‌ আবার কিভাবে জীবিত করবেন? একথায় আল্লাহ‌ তার প্রাণ হরণ করলেন এবং সে একশো বছর পর্যন্ত মৃত পড়ে রইলো। তারপর আল্লাহ‌ পুনর্বার তাকে জীবন দান করলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ বলো, তুমি কত বছর পড়েছিলে? জবাব দিলঃ এই, এক দিন বা কয়েক ঘন্টা পড়েছিলাম। আল্লাহ‌ বললেনঃ “বরং একশোটি বছর এই অবস্থায় তোমার ওপর দিয়ে চলে গেছে। এবার নিজের খাবার ও পানীয়ের ওপর একবার নজর বুলাও, দেখো তার মধ্যে কোন সামান্য পরিবর্তনও আসেনি। অন্যদিকে তোমার গাধাটিকে দেখো (তার পাঁজরগুলোও পঁচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে)। আর এটা আমি এ জন্য করেছি যে, মানুষের জন্য তোমাকে আমি একটি নিদর্শন হিসেবে দাঁড় করাতে চাই। তারপর দেখো, এই অস্থিপাঁজরটি, কিভাবে একে উঠিয়ে এর গায়ে গোশত ও চামড়া লাগিয়ে দিই।” এভাবে সত্য যখন তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো তখন সে বলে উঠলোঃ “আমি জানি, আল্লাহ‌ সবকিছুর ওপর শক্তিশালী।” – তাফহীমুল কুরআন।

এই আয়াতে অনেক লুকায়িত অর্থ আছে।  আমি শুধু গাধার সাথে সম্পৃক্ত অর্থগুলো ফোকাস করবো। একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন এগুলোর আসল লুকায়িত অর্থ।

শ্যাই: তাহলে, তুমি কি করে এর অর্থ গুলো জানো?

গাধা: যে শিখতে ও জানতে চায়, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। আয়াত [৬২:৫] এর লিংক আছে।

শ্যাই: ও আচ্ছা।

গাধা: এই ঘটনায় সেই ব্যক্তিটি ছিলেন একজন নবী। তিনি তার জাতিকে আল্লাহর পথে আহবান করতেন। তার জাতি তার দীনের দাওয়াত গ্রহণ করছিলো না। তাদের এহেন আচরণ দেখে, সেই নবী হতাশ হয়ে তার অনুভূতি ও চিন্তা ব্যক্ত করেন এবং এতে তার কি পরিনাম হয় সেটার বর্ণনা করা হয়েছে।

“অথবা দৃষ্টান্তস্বরূপ সেই ব্যক্তিকে দেখো যে এমন একটি লোকালয় অতিক্রম করেছিল, যার গৃহের ছাদগুলো উপুড় হয়ে পড়েছিল। সে বললোঃ এই ধ্বংসপ্রাপ্ত জনবসতি, একে আল্লাহ‌ আবার কিভাবে জীবিত করবেন?”

– এখানে “লোকালয়” বলতে সেই নবীর জাতির পথভ্রষ্ট গোষ্ঠীকে বোঝানে হয়েছে। আর “গৃহের ছাদগুলো উপুড় হয়ে পড়েছিল” বলতে তাদের আত্মিক সত্তা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা নষ্ট হয়ে দূষিত আবরণে ঢেকে ছিল বোঝানে হয়েছে। তিনি তার জাতির কাছে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতেন। তার জাতির লোকেরা দীনের দাওয়াত গ্রহণ করছিলো না। তার জনগোষ্ঠীর লোকদের ব্যাপারে সেই ব্যক্তি ভাবলো, এই পথভ্রষ্ট গোষ্ঠী যাদের আত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা নষ্ট (spiritual and intellectual dead) হয়ে গেছে তাদেরকে আল্লাহ কিভাবে জীবিত করবেন, অর্থাৎ তারা কিভাবে সঠিক পথ পাবে। এটা সম্ভব না। এটা ছিল সেই ব্যক্তির চিন্তা ও অভিমত।

“একথায় আল্লাহ‌ তার প্রাণ হরণ করলেন এবং সে একশো বছর পর্যন্ত মৃত পড়ে রইলো। তারপর আল্লাহ‌ পুনর্বার তাকে জীবন দান করলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ বলো, তুমি কত বছর পড়েছিলে? জবাব দিলঃ এই, এক দিন বা কয়েক ঘন্টা পড়েছিলাম। আল্লাহ‌ বললেনঃ “বরং একশোটি বছর এই অবস্থায় তোমার ওপর দিয়ে চলে গেছে। এবার নিজের খাবার ও পানীয়ের ওপর একবার নজর বুলাও, দেখো তার মধ্যে কোন সামান্য পরিবর্তনও আসেনি।”

– এখানে “খাবার” বলতে বুঝানো হয়েছে কিতাব বা বাণীগুলো যেটা তাকে দেয়া হয়েছিল এবং পানি বলতে “আল্লাহর হেদায়েত” যেটা তার কাছে আসছিল। অর্থাৎ সে নবীর কাছে আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব ও হেদায়েত অক্ষত ছিল, ওগুলোর কোনো পরিবর্তন হয় নাই। এটা দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করা হয় যে সে এখনো আল্লাহর মনোনীত।

“অন্যদিকে তোমার গাধাটিকে দেখো (তার পাঁজরগুলোও পঁচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে)। আর এটা আমি এ জন্য করেছি যে, মানুষের জন্য তোমাকে আমি একটি নিদর্শন হিসেবে দাঁড় করাতে চাই। তারপর দেখো, এই অস্থিপাঁজরটি, কিভাবে একে উঠিয়ে এর গায়ে গোশত ও চামড়া লাগিয়ে দিই।” এভাবে সত্য যখন তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো তখন সে বলে উঠলোঃ “আমি জানি, আল্লাহ‌ সবকিছুর ওপর শক্তিশালী।”

এখানে গাধার বর্ণনা থেকে অনেক ধরনের অর্থ হয়। আমি তিন ধরনের অর্থ এখানে উল্লেখ করলাম।

১) গাধার দেহাবশেষ, যেটার অস্থিপাঁজরটি দাঁড় করিয়ে মাংস লাগিয়ে জীবিত করা হয়।  যেটা মূলত সব বাংলা ও ইংলিশ অনুবাদে আছে। এটা খুব সাধারণ অর্থ।

২) গাধা এখানে এরকম এক ব্যক্তি যার আত্মিক সত্তা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা উভয়ে নষ্ট হয়ে দূষিত আবরণে ঢেকে আছে। “অস্থিপাঁজর” দিয়ে ব্যক্তির “আত্মিক সত্তা” কে বুঝানো হয়েছে এবং “মাংস” দিয়ে তার  “বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা” কে  বুঝানো হয়েছে। তাহলে আয়াতের এই অংশের বর্ণনাতে বলা হচ্ছে, আল্লাহতালা কি ভাবে একজন পথভ্রষ্ট মানুষের আত্মিক সত্তা সঠিক করে তার বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাদিয়ে যুক্ত করে দেন।  যেটা সেই ব্যক্তি অসম্ভব মনে করেছিল এবং অভিমত দিয়েছিলো যে আল্লাহ কি করে এই পথভ্রষ্ট মানুষদেরকে আবার সঠিক পথের দিশা দিবেন। এই ঘটনার ভিতরে আল্লাহ দেখালেন যে আল্লাহ সব পারেন এবং সর্ব ক্ষমতাবান।

৩) এখানে অস্থিপাঁজর বলতে নেতা বা ধর্ম প্রচারক কে বুঝানো হয়েছে এবং মাংস বলতে তার অনুসরণকারীদের বা ফলোয়ারদেরকে বুঝানো হয়েছে। প্রথমে যেহূত তাকে দেখানো হয়েছে “খাবার” অর্থাৎ “কিতাব” এবং “পানি” অর্থাৎ “আল্লাহর হেদায়েত” তার জন্য অক্ষত আছে। তাই এখানে বুঝানো হচ্ছে যে, সে যখন আবার ধর্ম প্রচার করবে তখন তার অনেক অনুসারী হবে। এই বর্ণনার মাধ্যমে তাকে আশ্বস্ত করা হয় এবং দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়।

এই আয়াত থেকে বুঝা যায়, গাধা মানে সেই ব্যক্তি যার আত্মিক সত্তা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা আবরণে ঢাকা  আছে। তাকে যতই বুঝানো হোক বা কোনো চিহ্ন বা সংকেত দেখানো হোক সে তা বোঝেনা। অন্য কোথায় গাধা মানে যার অন্তরের ও চিন্তার চোখ বন্ধ। সেই নবী মনে করেছিলেন, যে তার জাতির অন্তরের ও চিন্তার চোখ বন্ধ, অর্থাৎ তারা গাধার সমতুল্য, এবং তারা কখনো আল্লাহর সঠিক পথ গ্রহণ করবে না। আর সে কারণেই আল্লাহ তাকে গাধার উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন যে আল্লাহ কিভাবে একজন অন্তরের ও চিন্তার চোখ বন্ধ মানুষকে (গাধাকে) সঠিক পথ দেখাতে পারেন।

শ্যাই: তাহলে এখানে গাধার উদাহরণ থেকে আমাদের জন্য কি শিক্ষা?

গাধা: গাধার উদাহরণ থেকে তোমাদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে – 

(১) তোমরা যারা মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করো, কখনো এই অভিমত ব্যক্ত করবা না যে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, তারা আর সঠিক পথ পাবেনা। সেই নবী হচ্ছেন তোমাদের জন্য একটা নিদর্শন। আল্লাহ‌ সবকিছুর ওপর শক্তিশালী আর তিনি চাইলে সবই সম্ভব। সুতরাং আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান করে যেতে হবে, কখনো হতাশ হওয়া যাবে না। প্রত্যেক ব্যক্তিই একজন সম্ভাবনাময় আলোর পথিক। প্রত্যেক জাতিরই সম্ভাবনাময় আলোকিত ভবিষ্যৎ থাকে। নিশ্চই আল্লাহ তোমাদের ডাকে মানুষকে সত্য-সঠিক পথের দিশা দিবেন।

শ্যাই: হুম, বুঝলাম।  এটাতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ  শিক্ষা।

গাধা:হ্যা।

শ্যাই: তাহলে, এই আয়াতে গাধার উদাহরণ দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে?   “তোমাদের আরোহণ করার এবং তোমাদের জীবনের শোভা-সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন। তিনি (তোমাদের উপকারার্থে) আরো অনেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন, যেগুলো তোমরা জানোই না[১৬:৮]।”

গাধা: এখানে “ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা” কে তোমাদের পরিবহন ও যাতায়াতের উপকারার্থে বুঝানো হয়েছে। যেহেতু এখানে একটা প্রাণীর গ্ৰুপ হিসেবে বলা হয়েছে তাই এটা সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

শ্যাই: আর, এখানে গাধার উদাহরণ দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে? “নিজের চলনে ভারসাম্য আনো এবং নিজের আওয়াজ নীচু করো। সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে গাধার আওয়াজ।[৩১:১৯]”

গাধা: আমি এখান থেকে ২ টি অর্থ বুঝি। একটা যেটা এই অনুবাদে আছে। এটা সাধারণ অর্থ। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, তোমরা চিন্তা ভাবনা করে কম কথা বলবে, কথাবার্তার মধ্যে মূর্খের কথা সবচেয়ে খারাপ। গাধাকে মূর্খ, অন্ধ (অন্তরের চোখে), চিন্তার উপর আবরণ পরেছে ইত্যাদি ভাবে বুঝানো হয়েছে।

শ্যাই: তাহলে এখানে আমাদের জন্য কি শিক্ষা আছে?

গাধা: (২) কথাবার্তা বলবে বা জ্ঞান শিক্ষা দিবে চিন্তা ভাবনা করে। মূর্খের জ্ঞান শিক্ষা নিকৃষ্টতম, অর্থহীন কথাবার্তা।

শ্যাই: আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। 

গাধা: হুম। 

শ্যাই: তাহলে এই আয়াতে?

“যাদেরকে তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি, তাদের উপমা সেই সব গাধা, যা বই-পুস্তক বহন করে। এর চেয়েও নিকৃষ্ট উপমা সেই সব লোকরে যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে। আল্লাহ এ রকম জালেমদের হিদায়াত দান করেন না [৬২:৫]।

গাধা: “যাদেরকে তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি, তাদের উপমা সেই সব গাধা, যা বই-পুস্তক বহন করে।”

এখানে সাধারণ অর্থে বুঝানো হয়েছে যে, যাদের তাওরাতের জ্ঞান ছিল এবং তাওরাত অনুসারে দুনিয়াকে পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তারা তাদের এ দায়িত্ব বুঝেনি এবং তার হকও আদায় করেনি। এখানে বিশেষ অর্থটা হচ্ছে, সে ব্যক্তি যাকে তাওরাতের বাহক করা হয়েছিল, সেটা সে বহন করেনি। এখানে আয়াত ২:২৫৯ সেই ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। সেখানে “লোকালয়” বলতে সেই নবীর জাতির পথভ্রষ্ট গোষ্ঠীকে বোঝানে হয়েছে। আর “গৃহের ছাদগুলো উপুড় হয়ে পড়েছিল” বলতে তাদের আত্মিক সত্তা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা নষ্ট হয়ে দূষিত আবরণে ঢেকে ছিল বোঝানে হয়েছে। এই আয়াতে আল্লাহ তাদের উপমা দিচ্ছেন গাধা বলে। তাহলে দুই আয়াত লিংক করলে গাধার অর্থ হয় “যার আত্মিক সত্তা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা নষ্ট হয়ে দূষিত আবরণে ঢাকা”। যে বই-পুস্তক বহন করে অথচ সেটা থেকে আল্লাহর নিদর্শন দেখেনা ও বোঝেনা। এ ভাবে অর্থ বের করার টেকনিক কে তোমার “Principle of Relevance” বলতে পারো।

শ্যাই: Principle of Relevance? এটা আবার কি?

গাধা: কোরআন শরীফের কোনো শব্দের অর্থ বুঝতে অসুবিধা হলে, সেই শব্দ কত আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে সেটার লিস্ট তৈরী করে, খুঁজতে হবে কোথায় এর ডেফিনেশন বা সংজ্ঞা আছে। অথবা কোনো স্টোরিতে সেই শব্দটা থাকলে তার কনটেক্সট থেকে অর্থ বুঝতে হবে। তারপর সেই অর্থ অন্য সব আয়াতের সেই শব্দের অর্থ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। এটাই হলো প্রিন্সিপল অফ রেলেভেন্স (Principle of Relevance)।

শ্যাই: তাহলে এই আয়াতে আমাদের জন্য কি শিক্ষা আছে?

গাধা: অনেক বড় শিক্ষা। (৩) তোমরা যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করো তারা যেন কিতাবের নিদর্শন (আয়াত মানে চিহ্ন, সাইন) গুলো দেখতে ও বুঝতে পারো। অসুবিধা হলে আল্লাহর সাহায্য চাও। তোমরা যারা ইসলামের পথে চলো, সর্বদা আল্লাহর কাছে সমর্পন হবে এবং একমাত্র তারই কাছে সাহায্য চাইবে। একমাত্র আল্লাহ পারেন তোমাদের আত্মিক সত্তাকে ঠিক করে বুদ্ধিবৃত্তিক সঠিক চিন্তার বিকাশ ঘটাতে, তোমাদের অন্তরের ও চিন্তার চোখ খুলে দিতে। সাবধান, গাধার মতো কিতাব বা ইসলামের পতাকা বহন করবে না। আল্লাহর নিদর্শন সার্বজনীন, কখনো অর্থহীন হয় না।

শ্যাই: আমাদের দেশে তো অনেক হুজুর আছেন যারা কোরআন পড়েন ও মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকেন।  অথচ তাদের কথা ও কাজ দেখলে তো মনে হয় না যে তারা আল্লাহর নিদর্শন দেখে ও বোঝে। তুমি কি বলো?

গাধা: তোমাদের এই সকল হুজুরদের উদাহরণ হচ্ছে তোমার অচিনপুরের গল্পের মাঝির মতো। তুমি “মাঝি” শব্দকে “হুজুর” শব্দ দিয়ে আর “পানি” কে  “সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ” দ্বারা প্রতিস্থাপন করো। তুমি কি কোনো মিল খুঁজে পাও?

শ্যাই: একটু সময় দাও। … আশ্চর্য! অনেক মিল। এটাও সম্ভব?

গাধা: হ্যা। তোমরা যেহেতু একই প্রকৃতি ও পরিবেশের মানুষ তাই তোমাদের মধ্যে চরিত্রগত মিল বেশি। বাহ্যিকভাবে তোমরা যে লেবাসই পরিধান করো না কেন। অথবা ভিন্ন ভাবে কথা বলোনা কেন, অথবা  ভিন্ন কাজ করে দেখাও না কেন, তাতে তোমাদের অন্তরের চরিত্রের খুব একটা পরিবর্তন আসে না। সব সমাজেই কিছু ব্যতিক্রম থাকবে, তারা Outlier (বহিরাগত), সমাধানের সমীকরণে থাকে না।

শ্যাই: তাহলে, আমাদের জন্য তোমার কি পরামর্শ আছে?

গাধা: তোমাদের প্রকৃতির দিকে তাকাও। দেখো, আল্লাহতালা জান্নাতের (বাগান) যে বর্ণনা করেছেন তার সাথে তোমাদের প্রকৃতির অনেক মিল আছে।  তোমাদের দেশে প্রচুর গাছ আছে, নদী ও পানি আছে, অনেক ধরনের ফল-ফলাদি হয়, তোমাদের মাটিতে বীজ দিলেই সেটা ফল দেয়। এক কোথায় আল্লাহ্তালা তোমাদেরকে দান করেছেন নেয়ামতপুর। আর তোমরা এটাকে বানায় রাখলে জাহিলীপুর।

শ্যাই: কি? নেয়ামতপুরকে বানাই দিলাম জাহিলীপুর?

গাধা: হ্যা। একটু চিন্তা করো।

শ্যাই: (লজ্জাবোধ করছে) তাহলে, আমাদের করণীয় কি?

গাধা: তোমরা প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে শিখবে, যেমন গাছ, মাছ ও অন্নান্য প্রাণী যেটা তোমাদের প্রকৃতির মাঝে আছে। তোমাদের বাতাস, পানি, ও মাটি থেকে শিখবে। এগুলো সবই তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন।

শ্যাই: থামো, থামো। গাছ, মাছ, বাতাস, পানি, মাটি থেকেও শিক্ষা?

গাধা: হ্যা। তোমার তোমাদের প্রকৃতির একটা অংশ। তোমাদের চরিত্র ও চিন্তা ভাবনার উপর তোমাদের প্রকৃতির অনেক প্রভাব আছে। যেমন তোমাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট তোমাদের মাটির সাথে মিল আছে। না বুঝলে, মাটিকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো?

শ্যাই: (নিরেট মূর্খ ও অন্ধ মনে হতে লাগলো) তাহলে আমরা মুসলমানরা কি আরবের প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা করবোনা?

গাধা: তোমাদের জন্ম বাংলায়। আগে বাংলার প্রকৃতি, পরিবেশ, পশু-প্রাণী, গাছ-পালা, নদী-পানি, মাটি, বাতাস নিয়ে চিন্তা করো। আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান এবং তার নিদর্শন সব কিছুতেই। অন্তরের ও চিন্তার চোখে আবরণ দিবেনা। আল্লাহপাক সর্বোচ্চ জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাশীল।

শ্যাই: ধন্যবাদ। আজ তাহলে যাই।

গাধা: ঠিক আছে, তবে যখন কোনো গাধার কথা মনে হবে, তখন না হেসে, এই দোয়াটি পড়বে। “রাব্বি যিদনী ইলমা – হে আমার পরওয়ারদিগার! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও। [২০:১১৪].”

শ্যাই: ইনশাল্লাহ, চেষ্টা করবো।

গাধা: আমার শিক্ষা ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো।

শ্যাই:  ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে দিবো।

শ্যালো ইনসান গাধার কথা ভাবছে। নিজেকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। দূর দূরান্তের সব কিছু ঝাপসা লাগছে। হঠাৎ কুকুরের ডাকে চমকে উঠে  ………. চলবে………

Shallow Insan

We strive to break the barrier of the superficial form of thinking to understand and explain complex and interrelated designed events and systems.

Leave a Reply