সাপ থেকে কি শিক্ষা নিতে পারি : পর্ব – ১.৬ (সাপের ৭টি বৈশিষ্ট্য, ইবলিসের ৭টি কৌশল, ও জাহান্নামের ৭টি দরজা)

snake

ফ্ল্যাশব্যাক – (সে লক্ষ্য করলো একটা অজগর সাপ। পিলে চমকে উঠলো )। শ্যালো ইনসান দেখলো একটা সাপ তার খুব কাছে চলে এসেছে।

সাপ: কি, আমায় দেখে ভয়ে দৌড় দিবে নাকি?

শ্যাই: না, একটু সংযত হয়ে, সাহস সঞ্চার করে বললো, না পালাবো না? 

সাপ: সাহস আছে দেখি। ভয় লাগে না।     

শ্যাই: ভয় একটু লাগে, তবে তোমার সাথে কথা বলতে চাই।  তোমার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই। 

সাপ: বলো। কি জানতে চাও ?

শ্যাই: বাইবেল বর্ণনা আছে যে, আদম ও ইভ কে সার্পেন্ট বা সাপ তাকে একটি গাছের ফল খেতে বলে।  এর মানে কি? আবার সাপের সাথে Tree of Knowledge Good and Evil (ট্রি অফ নলেজ গুড এন্ড ইভিল) এবং Tree of Life (ট্রি অফ লাইফ) এর সম্পর্ক কি? তাছাড়া ঐতিহাসিকভাবে অনেক ধর্মে সাপের প্রতীক আছে। হিন্দু ধর্মে কুণ্ডলিনী যোগা (Yoga) তে সাপের প্রতীক ব্যবহার করে।  মানে কি? তাছাড়া সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো মেডিকেল সাইন্সে সাপের প্রতীকের ছড়াছড়ি। এমনকি ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানিজশন (WHO) তাদের লোগোর ভিতর সাপের ছবি। এটা কেন? সাপের সাথে হেলথ এর কি সম্পর্ক? 

সাপ: থামো থামো। তুমি অনেক প্রশ্ন করছো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো কিনা জানিনা।  একটু ভাবতে দাও।  

শ্যাই: আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটাতো এখনো করেনি। পবিত্র কোরআনে মুসা (আ:) ও ফেরাউনের ঘটনায় সাপ দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে ও সেখান থেকে আমাদের জন্য কি শিক্ষা আছে?

সাপ: হুম। তোমার মনে দেখি অনেক প্রশ্ন। ঠিক আছে, তোমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিবো। তোমাকে আমি ইসলামের আলোকে উত্তর দিবো। 

শ্যাই: ঠিক আছে। সে ভাবেই বলো। 

সাপ: সাপকে বুঝতে হলে ইবলিসকে ও তার কৌশলকে বুঝতে হবে। সাপের বৈশিষ্ট্যের সাথে ইবলিসের ও জাহান্নামের একটা সম্পর্ক আছে।    

শ্যাই: বলো কি? তাই নাকি? 

সাপ: ইবলিসের কৌশলের সাথে সাপের বৈশিষ্ট্যের মিল আছে। কোরআন শরীফে ইবলিস তার ৭ টি কৌশল বর্ণনা করেছে, যার মাধ্যমে সে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে রাখবে। এই ৭ টি কৌশল এর সাথে জাহান্নামের ৭ টি দরজার ও সাপের ৭ টি বৈশিষ্ট্যের মিল আছে। 

শ্যাই: তাই নাকি? অবাক কথা। আমিতো এরকম কখনো শুনিনি।

সাপ: তোমরা আসলে অনেক কিছুই কখনো শুনোনি। আগে ইবলিসের ৭টি কৌশল বর্ণনা করি তারপর সাপের বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করবো।

শ্যাই: ঠিক আছে। শুনি, পবিত্র কোরআনে কোথায় ইবলিসের ৭টি কৌশল বর্ণনা হয়েছে।   

সাপ: সূরা আল আরাফে ৫টি কৌশল এবং সূরা আল-হিজরে  ২টি কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে।   

“সে বললোঃ “তুমি যেমন আমাকে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেছো তেমনি আমিও এখন তোমার সরল-সত্য পথে এ লোকদের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকবো [৭:১৬]”। কৌশল – ১

“আমি তাদের সামনে, পেছন, ডান, বাম দিক থেকে তাদের কাছে আসবো, এবং তারপর আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না [৭:১৭]”। কৌশল – ২,৩,৪,৫

“সে বললো, হে আমার রব! তুমি যেমন আমাকে বিপথগামী করলে ঠিক তেমনিভাবে আমি পৃথিবীতে এদের জন্য প্রলোভন সৃষ্টি করবো এবং এদের সবাইকে বিপথগামী করবো [১৫:৩৯]”। কৌশল – ৬,৭

শ্যাই: তুমি এখানে কৌশলকে কিভাবে বিশ্লেষণ করছো, সেটা আমার কাছে পরিষ্কার না।  

সাপ: আচ্ছা , বুঝাই বলছি।

কৌশল – ১

“সে বললোঃ “তুমি যেমন আমাকে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেছো তেমনি আমিও এখন তোমার সরল-সত্য পথে এ লোকদের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকবো [৭:১৬]”

এই কৌশলের অর্থ হচ্ছে ইবলিস মানুষ এবং আল্লাহর মাঝখানে অবস্থান করবে মাধ্যম হিসেবে। অর্থাৎ সে মানুষকে শিরকের পথে নিয়ে যাবে। এখানে ইবলিসের প্ররোচনায় মানুষ আল্লাহর সাথে সরাসরি সম্পর্ক না স্থাপন করে অন্য কাউকে মাধ্যম হিসাবে নিবে।  এই মাধ্যম কোনো মূর্তি বা কোনো বস্তু বা অন্য কোনো মানুষ হতে পারে।  যেমন কোনো পীর বা গুরু বা ওস্তাদ, মানুষ যাদেরকে এমন ভাবে অনুসরণ করে বা বিশ্বাস করে যে এই সকল মাধ্যম ব্যক্তি তাদেরকে পার্থিব জীবনে ও আখেরাতে সফলতা দিতে পারবে। এই কৌশলে ইবলিসের অবস্থান হচ্ছে ‘উপরে থেকে’ অর্থাৎ সে মানুষ এবং উপরের আল্লাহর মাঝে বসে থাকবে।

শ্যাই: কৌশল – ১ উপর থেকে না হয় বোঝা গেলো।  কিন্তু  কৌশল-২,৩,৪,৫ তো কিছুই বোঝা যায় না। 

সাপ: আচ্ছা , বুঝাই বলছি। কৌশল -২ সামনে থেকে। কৌশল-৩ পেছন থেকে। কৌশল-৪ ডান থেকে। কৌশল-৫ বাম থেকে।  এখন বলো, এই  সামনে, পেছন, ডান, বাম দিয়ে তুমি কি বুঝেছো?

শ্যাই: আমার মনে হয়, সবদিক বা চারিদিক থেকে ঘিরে ধরবে। 

সাপ: হা হা হা, তোমার নাম কি ? 

শ্যাই: (লজ্জায় মুখ লাল…) আমার নাম শ্যালো ইনসান।

সাপ: নাম শুনেই বুঝা যায় তোমার জ্ঞানের গভীরতা। তোমরা আসলেই কোনো বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করো না।  কোরআন পাঠের সময় ভালো করে চিন্তা করোনা যে আয়াত গুলোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। আল্লাহ্তালা এই সূরা আরাফের পরবর্তী আয়াতগুলোতে ইবলিসের এই কৌশলগুলো বর্ণনা করেছেন।  আমি সেখান থেকে তোমাকে ব্যাখ্যা করে বলেছি।

কৌশল -২ : সামনে থেকে

সামনে কথাটা অর্থ হচ্ছে পূর্ব-পুরুষ অর্থাৎ মানুষকে ইবলিস তাদের পূর্ব-পুরুষ বা বাপ-দাদাদের পথ অনুসরণ করাবে। এই আয়াত ৭:২৮ লক্ষ্য করো। 

[৭:২৮] তারা যখন কোন অশ্লীল কাজ করে তখন বলে, আমাদের বাপ-দাদাদেরকে আমরা এভাবেই করতে দেখেছি এবং আল্লাহই আমাদের এমনটি করার হুকুম দিয়েছেন। তাদেরকে বলে দাও, আল্লাহ‌ কখনো নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার হুকুম দেন না। তোমরা কি আল্লাহর নাম নিয়ে এমন কথা বলো যাকে তোমরা আল্লাহর কথা বলে জানো না? 

কৌশল -৩ : পেছন থেকে

এখানে “পেছন” কথাটার মানে হচ্ছে যেটা পরে আসবে অর্থাৎ ভবিষৎ।  এখানে এর অর্থ হচ্ছে মানুষ যেটা সঞ্চিত করে রাখে অদূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। যেটা বর্তমানে তার কাজে লাগেনা অথচ সে অদূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মজুদ করে রাখে। এক কথায় মজুদদারি বা অতিরিক্ত সঞ্চয় যেটা জিনিস কিংবা অর্থ হতে পারে। মানুষকে ইবলিস মজুদদারি বা অতিরিক্ত সঞ্চয় করার মাধ্যমে লাভবানের কথা বা ভবিষৎ এর নিশ্চিন্ততার কথা শুনাবে। “পেছন থেকে” কৌশলটা জ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।  কিছু মানূষ জ্ঞান অর্জনের পেছনে এমন ভাবে লেগে থাকে যাতে পরবর্তীতে অর্থাৎ ভবিষ্যতে তার পরিচিতি বাড়বে ও খ্যাতি হবে। এখানে ধর্মীয় জ্ঞানও অন্তর্ভুক্ত।  এ ধরনের মানুষেরাও ইবলিসের জালে আটকা। 

[৭:৩১] হে বনী আদম! প্রত্যেক ইবাদাতের সময় তোমরা নিজ নিজ সুন্দর সাজে সজ্জিত হও। আর খাও ও পান করো কিন্তু সীমা অতিক্রম করে যেয়ো না, আল্লাহ‌ সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পছন্দ করেন না। 

এখানে খাও ও পান করো মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে জীবন চলার জন্য যতটুকু লাগে সেই টুকু অর্থ-সম্পদ অর্জন করো ও ব্যায় করো। অতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ অর্জন করে সঞ্চিত করে বা মজুদ করে রাখাকে সীমা অতিক্রম অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। খাওয়া ও পান করাকে আল্লাহর হেদায়েত ও জ্ঞান হিসাবে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে খাওয়া ও পান করা উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। 

কৌশল -৪ ডান থেকে

“ডান” কথাটা কোরআনে অনেক ব্যবহার করা হয়েছে, যারা আল্লাহর পথে থাকে এই অর্থে। এখানে অতি-ডান দিক হিসাবে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ইবলিস মানুষকে অতিরিক্ত ভাবে ধর্ম পালন করার মাধ্যমে মানুষকে তার পথে নিয়ে যাবে। অতিরিক্ত ধর্ম পালন মানে যেটা আল্লাহ করতে বলে নাই অথচ মানুষ সে গুলোকে ধর্মের মধ্যে গণ্য করে পালন করতে থাকে। যেমন সংসার জীবন ত্যাগ করে শুধু ধর্ম পালন নিয়ে জীবন কাটানো। দুনিয়াতে জীবিকার জন্য কাজ করে অর্থ-সম্পদ অর্জনের কথা আল্লাহ বলেছেন। কিন্তু যারা কোনো কাজ না করে অন্য মানুষদের উপর জীবিকা নির্ভর করে চলে তারা আসলে আল্লাহর হালাল করা পদ্ধতিকে হারাম করে দিয়েছেন। 

[৭:৩২] হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাও, আল্লাহ‌ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব সৌন্দর্য সামগ্রী সৃষ্টি করেছেন, সেগুলো কে হারাম করেছে? আর আল্লাহর দেয়া পবিত্র জিনিসগুলো কে নিষিদ্ধ করেছে? বলো, দুনিয়ার জীবনেও এ সমস্ত জিনিস ঈমানদারদের জন্য, আর কিয়ামতের দিনে এগুলো তো একান্তভাবে তাদেরই জন্য হবে। এভাবে যারা জ্ঞানের অধিকারী তাদের জন্য আমার কথাগুলো আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্ণনা করে থাকি। 

কৌশল -৩ এবং কৌশল -৪ এর মধ্যে পার্থক্য হলো কৌশল -৩ অর্থ-সম্পদের ও জ্ঞানের পেছনে অতিরিক্ত চলা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। কৌশল -৪ অর্থ-সম্পদ বা জ্ঞান অর্জনে ধর্মের কথা বলে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা। দুটাই চরম এবং দুই প্রান্তে ইবলিসের জাল ছড়ানো। এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থানে চলতে বলা হয়েছে।     

কৌশল -৫ : বাম থেকে

“বাম” কথাটা কোরআনে অনেক ব্যবহার করা হয়েছে, যারা আল্লাহ ও তার বাণীকে অস্বীকার করে তাদের কে উদ্দেশ্য করে। তারা নিজেদের ক্ষমতা, জ্ঞান বা উপলব্ধির উপর অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। এখানে ইবলিস সেই সকল মানুষকে তাদের জ্ঞানের অহংকারের প্ররোচনার মাধ্যমে আল্লাহর কোরআনের আয়াতকে অস্বীকার করার পথে নিয়ে যাবে। এই বাম কৌশলে আক্রান্ত লোকেরা বেশির ভাগই সমাজের ক্ষমতাবান, জ্ঞানী ও অহংকারী ব্যক্তিরা।     

[৭:৩৫] হে বনী আদম! মনে রেখো, যদি তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে কোন রসূল এসে তোমাদেরকে আমার আয়াত শুনাতে থাকে, তাহলে যে ব্যক্তি আমার নাফরমানী করা থেকে বিরত থাকবে এবং নিজের কর্মনীতির সংশোধন করে নেবে, তার কোন ভয় এবং দুঃখের কারণ নেই। [৭:৩৬] আর যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা বলবে এবং তার সাথে বিদ্রোহাত্মাক আচরণ করবে, তারাই হবে জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে থাকবে তারা চিরকাল।

শ্যাই: তোমার কথাতো একদম সঠিক। এভাবে তো কখনো ভাবিনি। তাহলে কৌশল -৬ এবং ৭ কি ভাবে বুঝবো? 

সাপ: কৌশল -৬ এবং ৭ :

“সে বললো, হে আমার রব! তুমি যেমন আমাকে বিপথগামী করলে ঠিক তেমনিভাবে আমি পৃথিবীতে এদের জন্য প্রলোভন সৃষ্টি করবো এবং এদের সবাইকে বিপথগামী করবো [১৫:৩৯]”

এখানে কৌশল -৬ হচ্ছে – “আমি পৃথিবীতে এদের জন্য প্রলোভন সৃষ্টি করবো”। এখানে আরবি শব্দটা হলো “জীনা” এর অর্থ হলো “অলঙ্করণ”. অর্থাৎ কোনো জিনিসের উপর আরেকটা জিনিস বসিয়ে এটার আকর্ষণ বা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। আল্লাহতালা সূরা আল-কাহফ এই “জীনা” শব্দকে “সৌন্দর্য বিধান” হিসাবে উল্লেখ করেছেন। [১৮:৭] আসলে পৃথিবীতে এ যা কিছু সাজ-সরঞ্জামই আছে এগুলো দিয়ে আমি পৃথিবীর সৌন্দর্য বিধান করেছি তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্য থেকে কে ভাল কাজ করে।

তাহলে এই কৌশলের অর্থ হচ্ছে ইবলিস মানুষকে পৃথিবীর সাজ-সরঞ্জাম ও সৌন্দর্য দিয়ে আকৃষ্ট করে মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে ভুলেই রাখবে। বর্তমান সমাজের দিকে তাকাই দেখলেই বুঝা যাই ইবলিস তার এই কৌশলে কতটা সফল হয়েছে। মানুষ যেহেতু পৃথিবীর উপর হেটে বেড়াই, তাই পৃথিবী বা মাটি মানুষের নিচে অবস্থান করে। ইবলিসের পৃথিবীর সৌন্দের্যের আকর্ষণের কৌশলকে আমরা নিচে থেকে আক্রমণ বুঝবো। সুতরাং কৌশল -৬ হচ্ছে নিচে থেকে।  

কৌশল -৭ হচ্ছে – “এদের সবাইকে বিপথগামী করবো”। ইবলিস সবথেকে সহজে অনেক মানুষকে বিপথগামী করতে পারে যখন তারা দলবদ্ধভাবে একসাথে থাকে বা কাজ করে। দলের যে নেতা বা যার কথা সবাই শুনে, তাকে যদি একবার বিপথগামী করা যায় তাহলে দলের সবাই একসাথে বিপথগামী হয়। মানুষ বিভিন্ন কারণে দলবদ্ধ হয়। যেমন রাজনৈতিক কারণে, ধর্মীয় কারণে, খেলাধুলা, শিল্পকলা, বিনোদন মূলক ইত্যাদি। সুতরাংক এই ধরণের দলবদ্ধ অবস্থায় থাকাকালে দলের যারা নেতৃত্বে থাকে ইবলিস তাদেরকে বিপথগামী করে পুরো দলকে সহজেই বিপথগামী করতে পারে। এই দলবদ্ধ থাকা অবস্থায় কোনো মানুষ যদি তার চারিদিকের মানুষকে জিজ্ঞাসা করে তারা কি সঠিক পথে আছে? তাহলে তার চারিদিকের মানুষ তাকে বলবে হ্যা অবশ্যই আমরা সঠিক পথে চলছি। এ থেকে সেই ব্যক্তির বুঝার উপায় থাকেনা যে, সে সঠিক না কি খারাপ পথে আছে। এই কৌশলকে আমরা বলবো চারিদিক থেকে, অর্থাৎ ইবলিস চারিদিকের বিপথগামী মানুষ দ্বারা ঘিরে রাখে। সুতরাং ইবলিসের কৌশল -৭ হচ্ছে চারিদিক থেকে।            

শ্যাই: হুম।  তাহলে ইবলিসের ৭টা  কৌশল কি কি ? 

সাপ: কৌশল -১ উপর থেকে; কৌশল -২ সামনে থেকে; কৌশল -৩ পেছন থেকে; কৌশল -৪ ডান থেকে; কৌশল -৫ বাম থেকে; কৌশল -৬ নিচে থেকে এবং কৌশল -৭ চারিদিক থেকে। কোনো মানুষ যদি ইবলিসের কোনো একটা বা একাধিক কৌশলে পা দিয়ে চলে তার পথ সোজা জাহান্নামে। 

শ্যাই: মানে? মানুষ যদি ইবলিসের কোনো একটা বা একাধিক কৌশলে পা দিয়ে চলে, তাহলে সে জাহান্নামে যাবে? তুমি এটা এত আত্মবিশ্বাসের সাথে কি ভাবে বলছো ? 

সাপ: আমার এই আত্মবিশ্বাসের কারণ হলো, আল্লাহতালা ইবলিসের এই ৭টা কৌশল বর্ণনার পর বলেছেন জাহান্নামের ৭টা দরজার কথা।       

শ্যাই: সেটা কোথায়, কোথায়, এবং কিভাবে বলেছেন?

সাপ: এতো ঘাবড়ে গেছো কেন? আল্লাহতালা প্রতিদিন ও প্রতি মুহূর্ত দিয়েছেন তোমাদেরকে এই ইবলিসের কৌশল থেকে বেরিয়ে এক আল্লাহর পথে চলার জন্য। সুযোগ এখনো আছে, তাওবা করো। এই হচ্ছে আয়াতটি যেখানে ইবলিসের ৬ ও ৭ নম্বর কৌশল বর্ণনা শেষে আল্লাহ জাহান্নামের ৭ টি দরজার কথা বলেছেন।   

[১৫:৪৪] এ জাহান্নাম (ইবলীসের অনুসারীদের জন্য যার শাস্তির অঙ্গীকার করা হয়েছে) সাতটি দরজা বিশিষ্ট। প্রত্যেকটি দরজার জন্য তাদের মধ্য থেকে একটি অংশ নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে।

শ্যালো ইনসান বেশ অস্থির, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাবছে কখন যে ইবলিসের কোন কৌশলে আটকা পড়ছি। সেটা বুঝা মুশকিল তবে সতর্ক থাকতে হবে। একটু স্বাভাবিক হতে সে সাপকে বললো –      

শ্যাই: তুমি এগুলো জানলে কিভাবে?

সাপ: তাহলে শোনো। ইবলিসের এই ৭টা কৌশল বা বৈশিষ্ট্য আমার ৭টা বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল আছে। 

শ্যাই: সেটা কেমন?

সাপ: এখানে মনে রাখতে হবে যে সাপ বলতে বড় সাপ অর্থাৎ পাইথন বা কোবরা কে বুঝতে হবে। আমার ৭টা বৈশিষ্ট্য হলো – 

(১)  সাপ গাছে উঠতে পারে।  একবার কি ভেবে দেখেছো যে সাপের হাত বা পা নাই তারপরও সে কতো কষ্ট করে শরীরের মাসেল ব্যবহার করে ধীরে ধীরে গাছে উঠে। সাপ গাছে আরোহণ করে বাস করার কারণ মূলত দুটি।  এক. মাটিতে তার অনেক শিকারী থাকে। গাছে বাস করলে সে নিরাপদ থাকে তার মাটির শিকারিদের কাছ থেকে। দুই. গাছের উপর থেকে সে তার শিকারকে সহজেই আক্রমণ করতে পারে। কোনো প্রাণী গাছের কাছে বা নিচে আসলে সে সহজেই তা শিকার করতে পারে। মানুষ যখন গাছের কাছে যায় বা নিচে বসে তখন সাপ তাকে সহজেই আক্রমণ করতে পারে।        

কৌশল – ১ উপর থেকে

গাছের উপর সাপ বোঝায় সাপের অবস্থান উপরে।  অর্থাৎ ইবলিস উপর থেকে আক্রমণ করবে। কোরআনে  শরীফে গাছ দিয়ে বুঝানো হয়েছে “জ্ঞানের উৎস” আর গাছের ফল হলো “জ্ঞান”। সাপ যেমন মানুষকে আক্রমণ করে যখন সে গাছের কাছে আসে। ঠিক তেমনই ভাবে মানুষ যখন আল্লাহর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে তখন ইবলিস তাকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে অন্য কোনো মানুষ বা বস্তুর বা তার প্রবৃত্তির দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে মানুষ আল্লাহর পরিবর্তে অন্য মানুষ, বা কোনো মূর্তি বা বস্তু বা নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ বা দাসত্ব করতে থাকে। সেই ব্যক্তিকে বা মূর্তি বা বস্তুকে বা প্রবৃত্তিকে সাপের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে অন্য মানুষদেরকে আল্লাহকে অনুসরণের পরিবর্তে তাকে অনুসরণ করার কথা বলে। গাছের এই অর্থ ভালো করে বুঝতে পারলেই তুমি বুঝবে বাইবেলে কেন সাপকে গাছের উপর এবং কেন সে গাছের ফল খেতে বলে। 

(২) ঐতিহাসিকভাবে, সাপকে উর্বরতা বা সৃজনশীল জীবন শক্তির প্রতীকী হিসাবে ধরে। যেহেতু সাপ তার ত্বককে স্লফিংয়ের বা শেডিং এর ( sloughing, shedding) মাধ্যমে ফেলে দেয়, নতুন ত্বক তৈরী করে। অর্থাৎ সাপ যেহেতু খোলস বা খোসা বদল করতে পারে, তাই সাপকে অনেকে পুনর্জন্ম, রূপান্তর, এবং অমরত্ব প্রতীক হিসাবে বুঝান। 

কৌশল -২ : সামনে থেকে

সাপের খোলস বদলের মাধ্যমে যেমন শুধু তার বাহ্যিক পরিবর্তন হয় ভিতরের কোনো পরিবর্তন নেই।  ঠিক তেমনি ভাবে মানুষ তার বাপ-দাদাদের বা পূর্ব-পুরুষের বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনা নিয়ে চলতে থাকে। অর্থাৎ মানুষের ভিতরের চিন্তা-চেতনার কোনো পরিবর্তন নাই অথচ তার দেহ পরিবর্তন হয়ে দাদা থেকে বাবা, আর বাবা থেকে সে নিজে। সুতরাংক ইবলিস মানুষকে তার পূর্ব-পুরুষ বা বাপ-দাদাদের পথ অনুসরণ করাবে এবং সেই চিন্তা-চেতনার মধ্যে ধরে রাখবে।  

(৩) সাপ যখন খাদ্য গ্রহণ করে তখন সে অনেক বড় প্রাণী, এমনকি তার থেকে ওজনে বেশি প্রাণীকে সে গিলে ফেলতে পারে। সে যখন কোনো বড় প্রাণী খেয়ে ফেলে তারপর সাপ মাসের পর মাস না খেয়ে সেই খাদ্য ধীরে ধীরে হজম করতে থাকে। অর্থাৎ সাপ তার প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি খাদ্য গ্রহণ করে। 

কৌশল -৩ : পেছন থেকে

এখানে সাপ খাদ্য মজুদ করে রাখে অদূর ভবিষ্যৎ কথা চিন্তা করে। তেমনি ভাবে ইবলিস মানুষকে মজুদদারি বা অতিরিক্ত সঞ্চয় করার মাধ্যমে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি অর্জনের জন্য প্ররোচনা করে এবং ভবিষৎ এর নিশ্চিন্ততার কথা শুনায়।

(৪) সাপ চোখে কম দেখে। যদিও সাপের বাহিরে কোনো কান নেই, তবে তার মাথার ভিতরে কানের উপকরণ আছে। সাপ কানেও কম শুনে। সাপের জিহবা পরিবেশে কোনো কেমিকেল বা ভিন্ন তাপমাত্রা আছে কিনা সেটা শনাক্ত করতে সহায়তা করে। তাই সে যখন শিকার করে খাদ্য গ্রহণ করতে চাই সে তার জিহবা ব্যবহার করে তার চারপাশে অন্য কোনো প্রাণী বা তার খাদ্য আছে কিনা বুঝতে চেষ্টা করে। সাপের চোখ, কান থাকার পরও তাকে জিহবা ব্যবহার করতে হয় খাদ্য খোঁজার জন্য। 

কৌশল -৪ ডান থেকে

এখানে ইবলিস সাপের মতো কিছু ডান দিকের মানুষকে প্ররোচনা করবে এভাবে যে আরো বেশি বেশি করে ধর্ম পালন করতে হবে কোনো চিন্তা ভাবনা না করে। এরকম অনেক উদাহরণ আছে।  যেমন এখন ইমেইল এ অথবা টেক্সট মেসেজে এমন অনেক লেখা আসে এবং বলা হয় এটা ১০ বা ১০০ জনের কাছে শেয়ার করলে অনেক সওয়াব বা নেকি অর্জন হবে। আবার অনেক মানুষ এমন লেবাস পরে চলে বা কথাবার্তা বলে দেখলে মনে হয় সে সারাক্ষন নেকি অর্জনে ব্যস্ত। এরা ধর্ম পালন নিয়ে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত।  এদের উদাহরনণ হচ্ছে সাপের মতো যারা অন্তরের চোখে ভালোমতো দেখেনা এবং আল্লাহর কোনো কোথাও ঠিক মতো বোঝেনা। এরা জিহবা ঝুলিয়ে নেকি অর্জনের পথ খুঁজতে থাকে। যেটা আল্লাহ বলেনি, এরা সেটা আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছে।  

(৫) সাপের কাছে কোনো মানুষ বা প্রাণী আসলে সে ফণা তুলে ও গলার কাছের অংশ চওড়া করে ফোঁস ফোঁস শব্দে সতর্ক করে দেয় যে, সে তার কাছে ধরা দিবেনা বরং সে তাকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সুতরাং সাবধান আমি তোমার কাছে ধরা দিবোনা বা তোমার কথা শুনবো না। আমার কাছ থেকে দূরে থাকো, নাহলে বিপদ আছে। 

কৌশল -৫ : বাম থেকে

এখানে সাপের বৈশিষ্ট্য দিয়ে বুঝা যায় তার আত্মঅহংকার ও ক্ষমতা। ইবলিসের এই জালে যারা আটক পড়েছে তাদের অবস্থা এমন যে তাদের কাছে আল্লাহর আয়াতের কথা বললে, তারা আত্মঅহংকার সাথে তা অস্বীকার করে এবং নিজের ক্ষমতা ও জ্ঞানের গর্ব করে। এখানে ইবলিস সেই সকল মানুষকে তাদের ক্ষমতা ও জ্ঞানের অহংকারের প্ররোচনার মাধ্যমে আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করার পথে নিয়ে যাবে এবং বিশ্বাসীদেরকে ক্ষমতা ও চিন্তা-চেতনায় দুর্বল বা নিকৃষ্ট মনে করে ভয় দেখাবে।

(৬) মাটির ভিতর বাস করা ছাড়া সকল স্থলে বাস করা প্রাণীর পা আছে। শুধু সাপের বা সাপ জাতের কোনো পা নেই। সাপকে মাটির সাথে বুক রেখে চলা ফেরা করতে হয়। মাটির বুকে ঘষা দিতে দিতে সাপ চলতে থাকে।  

কৌশল -৬ : নিচে থেকে 

এখানে ইবলিসের কৌশলটা যেহেতু সে পৃথিবীর বা মাটির বুকে সৌন্দর্য বর্ধন করে মানুষকে সারাক্ষন পার্থিব জীবনের  কথা চিন্তা করাবে। ইবলিস মানুষকে পার্থিব জীবনের সফলতা ও আনন্দ -ফুর্তির মধ্যে ধরে রাখবে।  এখানে সাপের বুক যেমন সারাক্ষন মাটির সাথে সম্পৃক্ত থাকে চলতে গেলে, তেমনি যারা ইবলিসের এই কৌশলের শিকার তারা মাটির  বা পৃথিবীর চাকচিক্য ও  আনন্দ -ফুর্তির মধ্যে সারাক্ষন মেতে থাকে। এরা এমন ভাবে মাটি বা পৃথিবীর সাথে সম্পৃক্ত থাকে যে সে এ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। 

(৭) সাপ যখন কোনো বড় প্রাণী শিকার করে তখন সে তাকে সংকোচন করে বা সেটাকে চারিদিক থেকে পেচিয়ে ধরে শিকার করে। 

কৌশল -৭ চারিদিক থেকে

এটার উদাহরণ এমন যে যখন কোনো মানুষ দলবদ্ধ ভাবে বিপথগামী বা আল্লাহর পথ থেকে সরে যায় তখন তার অবস্থান এমন হয় যে, সে মাঝখানে অবস্থিত এবং তার চারিদিকে তারই মতো সব পথভ্রষ্ট মানুষ দিয়ে ঘেরা। অর্থাৎ ইবলিস এখানে তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে রাখে সব বিপথগামী পথভ্রষ্ট মানুষ দ্বারা। এমত অবস্থায় তার সঠিক বা আল্লাহর পথ পাওয়া একেবারেই সম্ভব। এটা একজন মানুষের সব থেকে খারাপ অবস্থা। তার আর কোনো মুক্তি নেই সে অর্থে বুঝায়।  অর্থাৎ সাপ যেমন চারিদিক থেকে পেচিয়ে ধরে, এখানে ইবলিসও তেমনি ভাবে একজন মানুষকে চারিদিকের পথভ্রষ্ট মানুষদ্বারা পেচায় ধরে রাখে।     

শ্যাই: আশ্চর্য ! ইবলিস আর সাপের মধ্যে খুব মিল। 

সাপ: হু, ইবলিসের ৭টা কৌশল সাপের এই ৭টা বৈশিষ্ট্যের সমতুল্য।   

শ্যাই: আচ্ছা। তাহলে, পবিত্র কোরআনে মুসা (আ:) ও ফেরাউনের ঘটনায় সাপ দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে ও সেখান থেকে আমাদের জন্য কি শিক্ষা আছে?

সাপ: বলবো। তবে আগে তুমি  মুসা (আ:) ও ফেরাউনের ঘটনায় সাপের উদাহরণের একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও। 

শ্যাই: আল্লাহতালা মুসা (আ:) এর মাধ্যমে ফেরাউনকে মোজেজা দেখালেন যে আল্লাহর ইশারায় তার লাঠি সাপ হয়ে যাই, আবার সাপ লাঠি হয়ে যায়। ফেরাউন সেটাকে জাদু বলে অস্বীকার করে। তারপর ফেরাউন শহরের সব জাদুকরদের একত্র করে বুঝাতে চাই যে মুসা (আ:) এর লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া আসলেই একটা জাদু। যখন মুসা (আ:) এর সাপ অন্য সকল জাদুকরদের সাপকে গিলে ফেলে তখন জাদুকররা বুঝতে পারে এটা কোনো জাদু হতে পারেনা। তারা সকলে মুসা (আ:) এর রবের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং এক আল্লাহই বিশ্বাসী হয়ে যায়। এ নিদর্শন দেখার পরও ফেরাউন মুসা (আ:) রবকে অবিশ্বাস করতে থাকলো। সে তখন জাদুকরদের জিজ্ঞাসা করলো তার অনুমতি ছাড়াই তারা কেন মুসা (আ:) রবকে বিশ্বাস ও রক্ষাকর্তা হিসাবে মানলো। আমি তোমাদের হাত-পা কেটে গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করবো। জবাবে জাদুকররা বলেছিলো তাদের কাছে সত্য পরিষ্কার হওয়ার পর তারা তার কাছে  আত্মসমর্পণ করেছে, এবং তুমি (ফেরাউন) শুধু আমাদের পার্থিব জীবনের ক্ষতি করতে পারবে। 

সাপ: প্রাচীনকালে মিশরে এক দেবতা ওয়াডজেট বা উত, এদ্যো ইত্যাদি নামে ডাকা হতো। তাকে কোবরা সাপের বিভিন্ন রূপে বানানো হতো। তারই এক প্রতীকের নাম ছিল ইউরাইয়াস যেটা কিনা একটা কোবরা সাপের মূর্তি। ফেরাউনরা এই ওয়াডজেট দেবতায় বিশ্বাস করতো এবং ইউরাইয়াস অর্থাৎ সাপের মূর্তি ও প্রতীক ব্যবহার করতো। ফেরাউনরা বিশ্বাস করতো এই দেবতা তাদের ক্ষমতা ও রক্ষাকর্তা। এখন কোরআনে মুসা (আ:) ও ফেরাউনের ঘটনায় সাপ দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে, সেটা এবার বলি।  

শ্যাই: ঠিক আছে বলো। 

সাপ: কোবরা সাপ যেমন তার সীমানায় কাউকে আসতে দেয়না। ছোবল মেরে, বিষ দিয়ে অথবা পেচিয়ে ধরে অন্যকে শেষ করে ফেলে  তার সীমানা রক্ষা করে। তেমনি ফেরাউনরা মনে করতো তার সীমানায় তারাই ক্ষমতাধর ও রক্ষাকর্তা। তাকে কেউ কিছু করতে পারবে না। তারাই দেবতা, মানুষের রক্ষাকর্তা।  সাপের খোলস বদলের মতো বংশক্রমে তারাই এই রাজ্যের অধিকারী ও রক্ষাকর্তা জনম জনম ধরে। সাপের সব বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে ছিল। অন্যভাবে বলা যায়, ইবলিসের সকল বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে ছিল। সে নিজেই এক সাক্ষাৎ ইবলিস হয়ে মানুষকে তার কৌশলের মধ্যে আটকে রাখতো। সত্য দেখা বা অনুধাবন করা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।          

আল্লাহতালা মুসা (আ:) এর মাধ্যমে ফেরাউনকে বুঝালেন তুমি নিজেকে সাপের মতো দেবতা মনে করো।  রক্ষাকর্তা হিসাবে তোমার থেকেও একজন অধিক ক্ষমতাধর ও রক্ষাকর্তা আছেন যার ইশারায় লাঠি সাপ হয়ে যাই, আবার সাপ লাঠি হয়ে যায়। এটার অর্থ হলো ফেরাউন যে ক্ষমতার গর্ব করে তার থেকেও অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকজন আছেন, যার হাতে সকল ক্ষমতা। কিন্তু ফেরাউন সেটা অস্বীকার করলো এবং তাকে জাদুবিদ্যা বলে আখ্যা দিলো। 

১) এখন থেকে শিক্ষা হচ্ছে, বর্তমান সময়ে এরকম ফেরাউন মানুষিকতার অনেক মানুষ বাস করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, কেউ সামাজিক ক্ষমতায়, কেউ প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতায় আবার কেউ পারিবারিক ক্ষমতায় ফেরাউন হয়ে বসে আছে। এরা সকলে নিজের পরিসীমার মধ্যে নিজেকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ভাবে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে তাদের থেকেও একজন ক্ষমতাবান আছেন।    

যখন জাদুকরদের সাপকে মুসা (আ:) এর সাপ গিলে ফেললো, এটার অর্থ হলো এক আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও সবচেয়ে ক্ষমতাশীল। তিনি অন্য সকল ক্ষমতাকে ধ্বংস করতে সক্ষম। এই অনুভূতি থেকে সকল জাদুকর বিশ্বাস করলো সমস্ত ক্ষমতার মালিক হচ্ছে মুসা (আ:) এর রব। কিন্তু ফেরাউন এর কোনো উপলব্ধি হলোনা, সে অস্বীকার কারীদের মধ্যে থেকে গেলো।   

২) এখন থেকে শিক্ষা হচ্ছে, যখন এই সকল ফেরাউন মানুষিকতার লোকেরা আল্লাহর কোনো চিহ্ন বা নিদর্শন দেখবে, তারা যেন সেটা নিয়ে চিন্তা করে এবং নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পন করে। আল্লাহ তাদের ক্ষমতা ধ্বংস করে দিতে পারেন খুব সহজেই। অস্বীকার কারীদের পরিণতি খুবই ভয়াবহ। 

ফেরাউনের হত্যার হুমকির জবাবে জাদুকররা বলেছিলো তাদের কাছে সত্য পরিষ্কার হওয়ার পর তারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, এবং তুমি শুধু আমাদের পার্থিব জীবনের ক্ষতি করতে পারবে। জাদুকরদের এমন বিশ্বাস ও আচরণ ফেরাউনকে চিন্তিত বা বিচলিত করলোনা। এ কথাগুলো শুনার পরও ফেরাউনের কোনো অনুশোচনা হলোনা বরং সে অহংকার কারীদের মধ্যে রয়ে গেলো। পরবর্তীতে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেলো।    

৩) এখন থেকে শিক্ষা হচ্ছে, যখন এই সকল ফেরাউন মানুষিকতার লোকেরা যাদের নিয়ন্ত্রণ করে, এবং তাদের মধ্যে থেকে কেউ যদি তার ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে অবিচল থাকে ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করে; তখন সেই ফেরাউন চরিত্রের মানুষ যেন বিষয়টা নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করে। এখানে আল্লাহর অনেক বড় নিদর্শন আছে। তাহলে সে অনুশোচনাকারী  হবে এবং অহংকারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। 

শ্যাই: এটাতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।  

সাপ: ঠিক তাই। 

শ্যাই: এবার তাহলে আমার অন্যান্য প্রশ্ন, যেমন বাইবেলের ঘটনা, হেলথ সেক্টরে সাপের ছবি ইত্যাদি একটু ব্যাখ্যা করে বুঝাবা।

সাপ: দুঃখিত। আমি এ সকল তোমাকে বুঝাতে পারবো না। কারণ এগুলো সব হলো মানসিক সমস্যা ও তার ব্যাখ্যা। ইবলিসকে অর্থাৎ তার কৌশল ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে হলে মানসিকভাবে বুঝতে হবে। তোমাদের চারপাশে যা আছে যেমন পশু-প্রাণী, গাছ-পালা, চন্দ্র-সূর্য এসব কিছু তোমাদের ভিতরে এদের বৈশিষ্ট্য হিসাবে আছে। অন্যভাবে বলা যায় তোমাদের বাহিরে যা আছে তা তোমাদের ভিতরে আছে। একে বলা হয় “প্রিন্সিপল অফ করেসপন্ডেন্স (Principle of Correspondence)” । আল্লাহতালা পবিত্র কোরআনে তার সমস্ত সৃষ্টিকে এমন ভাবে বর্ণনা করেছেন যাতে তোমার এগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করো, এবং তোমাদের ভিতরের অন্তরকে বা মন-মানুষিকতাকে বুঝতে সক্ষম হয়। তাতে করে তোমরা আল্লাহর নিদর্শন বুঝতে সক্ষম হবে এবং একনিষ্ট ভাবে তার দেয়া জ্ঞান ও পথ ধরে চলতে পারবে।

শ্যাই: হু। এটাতো অনেক কঠিন। আমরা কিভাবে এগুলো বুঝবো? 

সাপ: তোমাদেরকে একটু অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। একদিন সিগমন্ড উল্লাহ নামে এক ব্যক্তি আমার কাছে এসেছিলেন।  তিনি আমাকে বললেন ইবলিসের ৭টা কৌশল বা ইবলিসের ৭টা বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে থাকে। উনি এগুলোকে মানুষের ৭ ধরণের মানুষিক পক্ষপাত (Cognitive Biases ) বা মানসিক ব্যাধি (Cognitive Defects) বলে বর্ণনা করেন। আমি নিচে সেগুলো উল্লেখ করছি। উনি ভালো ভাবে ব্যাখ্যা করে বলতে পারবেন।

১) উপর থেকে – Selective Perception Bias

২) সামনে থেকে – Ostrich or Herd Bias

৩) পেছন থেকে – Choice Supportive Bias

৪) ডান থেকে – Anchoring Bias

৫) বাম থেকে – Overconfidence or Confirmation Bias

৬) নিচে থেকে – Bandwagon Bias

৭) চারিদিক থেকে – Collective Understanding or Heuristic Bias  

শ্যাই: হু। জীবনের এই বিকাল বেলায় মনে হচ্ছে, আমি আসলে নিজেকেই চিনতে পারি নাই। নিজেকে চিনতে পারলেই সবাইকে বা সব কিছুকে চিনতে পারবো। আমাকে সিগমন্ড উল্লাহ ভাইয়ের ফোন নম্বর দাও। 

সাপ: এই নাও সিগমন্ড উল্লাহর ফোন নম্বর। তবে আরো কিছু শিখতে চাইলে এই দুজনের নাম ও ফোন নম্বর নিয়ে নাও।  তাফসিরুল আলম – কোরআনের বিভিন্ন সৃষ্টির বর্ণনা দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে।  নুরুল হুদা – দর্শন,  বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও ধর্ম। 

শ্যাই: ইসলাম ধর্মে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা তোমার কাছ থেকে শিখলাম। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আজ চলি।   

সাপ:  ঠিক আছে, তবে যখন কোনো সাপের কথা মনে হবে, এই দোয়াটি পড়বে। “রাব্বানা জালামনা আনফুসানা ওয়াইল্লাম তাগফিরলানা  ওতারহামনা লানাকুননা মিনালখাসেরিন। – হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। এখন যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি রহম না করো, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো [৭:২৩]।”

শ্যাই: ইনশাল্লাহ, চেষ্টা করবো।

সাপ: আমার শিক্ষা ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো।

শ্যাই:  ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দিবো।

শ্যালো ইনসান ইবলিসের কৌশলের কথা ভাবছে। কখন যে ইবলিসের কৌশলের জালে আটকা পরি, আল্লাহর কাছে তাওবা করতে হবে প্রতিদিন। .………. চলবে………

পরবর্তী সংখ্যা – শয়তান কে বা কি, মানুষের ৩টা নাফ্স এবং আদম  (আ:) এর গাছের ফল খাওয়ায় আসলে কি ঘটেছিলো।

Shallow Insan

We strive to break the barrier of the superficial form of thinking to understand and explain complex and interrelated designed events and systems.

Leave a Reply