“হক্ক” শব্দের সারমর্ম: ইসলামের অধিকার ও কর্তব্যের মূলনীতি

অধিকার এবং কর্তব্য

১. অধিকার ও কর্তব্যের মৌলিক ধারণা

অধিকার এবং কর্তব্য হল ঘনিষ্ঠভাবে আন্তঃসম্পর্কিত একটি ধারণা। অধিকার হলো কোনো কিছুর দাবি বা এনটাইটেলমেন্ট। আর কর্তব্য কিছু করার একটি বাধ্যবাধকতা। একসাথে, এরা আমাদের নৈতিক এবং আইনী ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করে এবং একে অপরের সাথে আমাদের সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি গঠন করে।

অধিকার হল কিছু নির্দিষ্ট সুযোগ বা বিশেষাধিকারের গ্যারান্টি, যেমন জীবনের অধিকার, কথা বলার অধিকার, চলাফেরার অধিকার ইত্যাদি। কর্তব্য হল অধিকারগুলিকে সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের অবশ্যই করণীয় বিষয়। অধিকার এবং কর্তব্যের ধারণাগুলি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং তারা একটি পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান। একটি অধিকার অর্থবহ হওয়ার জন্য, অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তব্য থাকতে হবে যা নিশ্চিত করে যে অধিকারটি সুরক্ষিত এবং সমুন্নত রয়েছে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত মর্যদা এবং গোপনীয়তার অধিকার রয়েছে, এমনকি পরিবারের এর মধ্যেও। তদনুসারে, সমাজের ও পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত মর্যদা ও গোপনীয়তার গুরুত্ব স্বীকার করে একে অপরের ব্যক্তিগত মর্যদা ও গোপনীয়তাকে সম্মান করা কর্তব্য। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের তাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং বিশ্বাস প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। সে অনুসারে, পরিবারের মধ্যে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি শোনা, বিবেচনা করা, এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার নীতি অনুসরণ করা কর্তব্য।

আমরা অন্য ধরণের একটি উদাহরণ দিই, যেমন একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য, কর্মচারী এবং নিয়োগকর্তার অধিকার এবং কর্তব্যগুলি ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পর সম্পর্কিত, এবং এটি কর্ম সম্পদানে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। কর্মচারীদের তাদের কাজের জন্য বেতন পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং নিয়োগকর্তাদের সেই বেতন প্রদানের কর্তব্য রয়েছে। একইভাবে, নিয়োগকর্তাদের অধিকার আছে তাদের কর্মচারীরা তাদের উপর  অর্পিত কাজগুলি সম্পাদন করবে এবং কর্মচারীদের দায়িত্ব রয়েছে তাদের কাজগুলি যথাযতভাবে সম্পন্ন করার।  আরেকটি উদাহরণ, একজন কর্মচারীর একটি নিরাপদ পরিবেশে কাজ করার অধিকার রয়েছে, কিন্তু এই অধিকারটি তখনই অর্জন করা যেতে পারে যখন মালিক একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ প্রদান করে থাকে। একইভাবে, মালিক তাদের কর্মচারীদের কাছ থেকে কাজের নিরাপদ পরিবেশে বজায় রাখার দাবি রাখে। এই অধিকার তখনই অর্জিত হতে পারে যখন কর্মীরা নিরাপদ পরিবেশে রক্ষা ও বজায় রাখার জন্য তাদের দায়িত্ব পালন করে।

সাধারণভাবে, এটা বলা যেতে পারে যে, অধিকার এবং কর্তব্য একে অপরের পরিপূরক এবং পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল। কর্তব্য পালন ব্যতীত, অধিকার সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা যায় না। সংক্ষেপে, যেখানে একটি অধিকার আছে সেখানে একটি কর্তব্য রয়েছে। কারণ অধিকার এবং কর্তব্যের ধারণাটি ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পর সংযুক্ত এবং তারা একটি পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান। একটি অধিকার হল কোন কিছুর জন্য একটি দাবি বা এনটাইটেলমেন্ট, যখন একটি কর্তব্য হল কিছু করার জন্য একটি বাধ্যবাধকতা বা দায়িত্ব। একটি অধিকার অর্থবহ হওয়ার জন্য, সংশ্লিষ্ট কর্তব্য থাকতে হবে যা নিশ্চিত করে যে অধিকারটি সুরক্ষিত এবং সমুন্নত রয়েছে।

২. অধিকার ও কর্তব্যের ইসলামী ধারণা

২.১ “হক্ক” শব্দের অর্থ ও বিশ্লেষণ

ইসলামী শিক্ষা জুড়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও দৃষ্টিভঙ্গিতে অধিকার ও কর্তব্যের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে, আমরা আল্লাহর নাম এবং গুণ “আল-হক্ক” বিশ্লেষণের মাধ্যমে অধিকার ও কর্তব্যের ধারণা ব্যাখ্যা করব। আল-হক্ক, একটি বিশেষণ যার অর্থ সত্য, বাস্তব, সঠিক, যথাযথ এবং একটি বিশেষ্য যার অর্থ সত্যতা, বাস্তবতা সঠিকতা, যথাযথতা। “আল-হক্ক” আল্লাহর সত্তা এবং সৃষ্টির অন্তর্নিহিত প্রকৃতি উভয়কেই ধারণ করে। তাই সমস্ত সৃষ্টি “আল-হক্ক” অর্থাৎ সত্যের কাছে ঋণী। “আল-হক্ক” এটি নির্দেশ করে যে আল্লাহ হচ্ছেন পরম সত্য, চূড়ান্ত বাস্তবতা, এবং সমস্ত অস্তিত্বের একমাত্র উৎস। এই ধারণাটি আল্লাহর অধিকার, সৃষ্টির অধিকার এবং তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্যের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে।

পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন আয়াতে এই মর্মে বর্ণনা হয়েছে যে, আসমান ও পৃথিবীর সৃষ্টি, বার্তাবাহক প্রেরণ এবং আসমানী কিতাব অবতীর্ণ এই সমস্ত কাজই সত্য (হক্ক) ভাবে সম্পাদিত।, “হক্ক” এর স্বীকৃতির এবং এর তাৎপর্যের উপর জোর দিয়ে এটাকে চূড়ান্ত বাস্তবতা বলে মেনে চলার তাগিদ করা হয়েছে। নিম্নে কোরআনের আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির হক্ক বা সত্য সম্পর্কে কিছু বাণী তুলে ধরা হলো।

সূরা আর-রুম [৩০:৮]: “তারা কি তাদের নিজেদের সত্তা নিয়ে চিন্তা করেনি? আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এর মধ্যবর্তী সবকিছু সত্য (হক্ক) এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে সৃষ্টি করেছেন। অথচ অধিকাংশ মানুষই তাদের রবের সাথে সাক্ষাৎকে অস্বীকার করে!”

সূরা আল-আনআম [৬:৭৩]: “তিনিই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সঠিকভাবে সত্য (হক্ক) হিসাবে সৃষ্টি করেছেন । যেদিন তিনি বলবেন, ‘হও!’ এবং হয়ে যাবে! তাঁর আদেশ সত্য…”

সূরা আল-আনকাবুত [২৯:৪৪]: “আল্লাহ নভোমন্ডল ও পৃথিবীকে সঠিকভাবে সত্য (হক্ক) হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে ঈমানদারদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।”

সূরা আস-সাফফাত [৩৭:৩৭]: “প্রকৃতপক্ষে, তিনি (নবী) সত্য (হক্ক) নিয়ে এসেছিলেন, রসূলদের সত্যায়নকারী।”

সূরা আয-যুমার [৩৯:২]: “নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব নাযিল করেছি। সুতরাং দ্বীনের ব্যাপারে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদত কর।”

সূরা আয-যুখরুফ [43:29]: “প্রকৃতপক্ষে, আমি এই মক্কাবাসী এবং তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য ভোগের অনুমতি দিয়েছিলাম, যতক্ষণ না তাদের কাছে সত্য (হক্ক) এসেছিলেন এবং একজন রসূল যা স্পষ্ট করে দিয়েছিল।”

উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আল্লাহ সত্য এবং যা কিছু তাঁর সাথে সম্পৃক্ত তা সত্য। তাঁর প্রতিশ্রুতি সত্য, তাঁর বাণী বা কিতাব সত্য এবং তাঁর রসূলগণ সত্য। তাই নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তাহাজুদের নামাজের জন্য ঘুম থেকে উঠার সময় এই দোয়া করতেন:

[আল-বুখারী ১১২০] “হে আল্লাহ! সমস্ত প্রশংসা আপনার জন্য, আপনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের ধারক এবং তাদের মধ্যে যা কিছু আছে … এবং সমস্ত প্রশংসা আপনার জন্য; আপনি সত্য এবং আপনার প্রতিশ্রুতি সত্য, এবং আপনার সাথে দেখা করা সত্য, আপনার বাণী সত্য এবং জান্নাত সত্য এবং জাহান্নাম সত্য এবং সমস্ত নবী (সা.) সত্য; আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্য, এবং কিয়ামতের দিন সত্য…।”

“হক্ক”-এর মূল উপলব্ধি হল পরম হক হিসাবে আল্লাহকে স্বীকৃতি দেওয়া, এবং এই চূড়ান্ত সত্য এবং বাস্তবতা যা অন্য প্রতিটি সত্যের ভিত্তি তৈরী করে। সৃষ্টির প্রতিটি দিক, আল্লাহর সত্যের বহিঃপ্রকাশ হওয়ার কারণে, অন্তর্নিহিত অধিকার রয়েছে যা অবশ্যই সম্মান ও সুরক্ষিত করা উচিত। আল্লাহকে “যাচাই” এবং “উপলব্ধি” করার একমাত্র উপায় হল তাঁকে সত্য ও বাস্তব হিসাবে উপলব্ধি করা।

২.২ আল্লাহর “হক্ক” বা অধিকার

আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টিকে সত্য বা বাস্তব হিসেবে উপলব্ধি করার অর্থ কী? এটা শুধু কোনো কিছুর সত্যতা বা বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নয়। বরং এটি সেই স্বীকৃতির সাথে আসা ন্যায্য দাবিগুলিকে স্বীকার করার বিষয়। সুতরাং, প্রতিটি সত্য কিছু করণীয় বা পদক্ষেপের দাবি করে যখন আমরা সেই সত্যকে স্বীকার করি বা চিনতে পারি। আমরা যখন আল্লাহকে সত্য এবং প্রতিটি সৃষ্টিকে সত্য হিসাবে স্বীকার করি, তখন এটি আমাদেরকে আল্লাহকে সত্য এবং সমস্ত সৃষ্টির চূড়ান্ত স্রষ্টা হিসাবে বিশ্বাস করার দাবি করে। “হক্ক” বা সত্যের স্বীকৃতি কোনো নিষ্ক্রিয় বিষয় নয়; বরং এটি একটি সক্রিয় প্রতিক্রিয়ার দাবি করে, যার মধ্যে ওটার প্রতি বিশ্বাস বা কিছু করণীয়র প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সকলের চূড়ান্ত স্রষ্টা আল্লাহকে সত্য বলে বিশ্বাস করা আল্লাহর হক্ক বা অধিকার। আল্লাহকে আসমান ও জমিনের এবং এর মধ্যবর্তী সবকিছুর স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করা আল্লাহর অধিকার বা হক্ক। এভাবেই হক্ক “সত্য” ও “অধিকার” দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। 

সূরা লুকমান [৩১:৩০]: “এটা এই জন্য যে, আল্লাহই সত্য (হক্ক) এবং তাকে ছাড়া তারা যাকে ডাকে তা মিথ্যা, এবং কারণ আল্লাহই সর্বোচ্চ, সর্বশ্রেষ্ঠ।”

এই আয়াতে বলা হয়েছে যে আল্লাহই হচ্ছেন সত্য বাস্তবতা (“হক্ক”), অন্যান্য দেবতা যাদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকা হয় তারা মিথ্যা। এটি আল্লাহকে চূড়ান্ত সত্য, স্রষ্টা এবং ধারক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়; আল্লাহর উপাসনা এবং তার আনুগত্য সহ তাঁর প্রতি নির্দিষ্ট কর্তব্যগুলি অন্তর্ভুক্ত করে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর উপাসনা পাওয়ার অধিকার নেই এবং তাদের প্রতি আমাদের কোনো কর্তব্য নেই। উপরের সবগুলো আয়াতই ইঙ্গিত করে যে, আল্লাহর অধিকার এবং তাঁর প্রতি আমাদের কর্তব্য বোঝার জন্য হক বা সত্যকে স্বীকার করা অপরিহার্য।  

আয়াতগুলি এটা ব্যাখ্যা করে যে কীভাবে “হক্ক” (সত্য ও বাস্তবতা) এর ধারণাটি আল্লাহর একটি গুণ, তাঁর কর্ম, এবং একই সাথে ইসলামে অধিকার ও কর্তব্য বোঝার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। আল্লাহকে চূড়ান্ত সত্য হিসাবে স্বীকার করার অর্থ হলো সৃষ্টির উপর তাঁর অধিকারকে স্বীকার করা এবং তার প্রতি আমাদের কর্তব্য বোঝা। এই উপলব্ধিটি এমন একটি নৈতিক কাঠামোকে আকার দেয় যার মধ্যে মুসলমানদের সত্য, ধার্মিকতা এবং বিশ্বাসের প্রতিফলন হিসাবে দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে, যেখানে স্রষ্টার সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক বিভিন্ন দিক আলোকপাত করে।

২.৩ আমাদের প্রাকৃতিক বা ঐশ্বরিক অধিকার এবং কর্তব্য

এখন, আমরা আলোচনা করব আমাদের ঐশ্বরিক বা প্রাকৃতিক অধিকারগুলি নিয়ে, এবং যখন আমরা “হক্ক” এর উপর ভিত্তি করে সেই অধিকারগুলি উপভোগ করি তখন এটি কীভাবে কর্তব্য তৈরি করে। 

সূরা আত-তাহা [২০:৫০]: “আমাদের পালনকর্তা তিনি যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে তার সৃষ্টি দান করেছেন, অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন।”

মহান আল্লাহ, যিনি মহাবিশ্বের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং পথ প্রদর্শন করেছেন। ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি যে, আল্লাহর বাণী হচ্ছে “হক্ক” বা সত্য। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন এর অর্থ হল আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার এবং নির্দেশনা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাই সৃষ্টি হিসেবে আমাদের জীবন আমাদের হক বা অধিকার এবং পথনির্দেশনা পাওয়া আমাদের হক বা অধিকার।

কোরানের আয়াত সূরা আল-হিজর (১৫:১৯-২৩):  “এবং পৃথিবী – আমরা একে বিস্তৃত করেছি, এবং তার উপর পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে ভারসাম্যপূর্ণভাবে সর্বপ্রকার (জীবন) উৎপন্ন করেছি, এবং প্রদান করেছি। তাতে তোমাদের (হে মানুষ) জীবিকা নির্বাহের জন্য এবং সেই সাথে সকলের (জীবন্ত প্রাণীদের) জীবিকা নির্বাহের উপায়, যাদের জীবিকা তোমাদের উপর নির্ভর করে না। জীবিকা নির্বাহের এমন কোন মাধ্যম নেই যার মজুদ আমরা ধরে রাখি না, কেবলমাত্র সুনির্দিষ্ট পরিমাপে তা বের করে আনছি। এবং আমরা বায়ুকে উর্বর করার জন্য ছেড়ে দিয়েছি, এবং আমরা আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছি এবং তা তোমাদেরকে পান করতে দিয়েছি: এবং এর উৎসের নিষ্পত্তিকারী তোমরা নও- কেননা, দেখ, আমরাই জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটাই। এবং আমরাই চিরন্তন উত্তরাধিকারী।”

কুরআনের এই অনুচ্ছেদটি এই ধারণার উপর জোর দেয় যে আল্লাহ সকল জীবের জন্য রিজিক ও জীবিকার উৎস। এটি এই ধারণাটিকে হাইলাইট করে যে বিশ্বের সবকিছুর উৎস আল্লাহর মধ্যে রয়েছে এবং তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। তাই সকল প্রাণীরই জীবন ও জীবিকার অধিকার রয়েছে। জীবন ও জীবিকার অধিকার হল একটি “হক্ক” । মৌলিক স্তরে, আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদেরকে পথনির্দেশনা ও রিযিক প্রদান করেছেন। তাই আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে এগুলোর ওপর আমাদের অধিকার রয়েছে। এই অধিকারগুলো আল্লাহর নিরংকুশ অধিকারের সাথে জড়িত। সুতরাং, আল্লাহকে সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা, পথপ্রদর্শক এবং পালনকর্তা হিসাবে স্বীকার করার দায়িত্ব রয়েছে।

যেহেতু আল্লাহ সকল অধিকারের উৎস, তাই আমাদের অধিকার দাবী করতে হলে আমাদেরকে সত্য ও বাস্তবে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহই এসবের একমাত্র মালিক ও অধিকারী। এভাবে আমাদের অধিকার আল্লাহর প্রতি কর্তব্য তৈরি করে। যেহেতু আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদেরকে জীবনের অধিকার দিয়েছেন, হেদায়েত ও রিজিক পাওয়ার অধিকার দিয়েছেন, তাই আল্লাহকে সকলের স্রষ্টা, পথপ্রদর্শক ও ধারক হিসেবে বিশ্বাস করা একটি নৈতিক দায়িত্ব। এটা পারস্পারিক সম্পর্ক তৈরী করে যে, আল্লাহকে আমাদের অধিকারের উৎস হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া তাঁর প্রতি আমাদের কর্তব্যকেও স্বীকৃতি দেয়া – এই কর্তব্যগুলি মূলত আল্লাহর অধিকার। মোটকথা, আল্লাহ আমাদের জীবনের ‘হক্ক’ দান করেছেন এই বিশ্বাসই আল্লাহর একটি অধিকার যা পূরণ করা আমাদের কর্তব্য। এইভাবে “হক্ক” শব্দটি একটি দ্বৈততা সৃষ্টি করে, এটা একদিকে আমাদের অধিকার দেয়, আর অন্যদিকে এই অধিকারের জন্য আল্লাহর প্রতি কর্তব্য তৈরী করে। সুতরাং, আমাদের সকল প্রাকৃতিক বা ঐশ্বরিক অধিকার আল্লাহর প্রতি কর্তব্যের সাথে আসে।

যখন “হক্ক” শব্দটি সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত, তখন এটি কেবল তাদের “সত্য” বা তাদের “বাস্তবতা” বোঝায় না। বরং, এটি সেই ন্যায্য এবং যথাযথ দাবিগুলিকেও নির্দেশ করে যখন আমরা অন্যান্য সৃষ্টি বা মানুষের সংস্পর্শে আসি। যখন আমরা মানুষের সংস্পর্শে আসি, তখন আমরা স্বীকার করি যে তাদের অধিকার বা “হক্ক”ও আল্লাহ প্রদত্ত; এবং তাদের অধিকার সম্মান ও রক্ষা করা একটি নৈতিক দায়িত্ব। উদাহরণ হিসেবে, আল্লাহর দেওয়া জীবনের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে আমরা অন্যের জীবনকে সম্মান ও রক্ষা করার নৈতিক দায়িত্বও স্বীকার করি। “হক্ক” শব্দটি একটি দ্বৈততা তৈরি করে, এটি একদিকে আমাদের অধিকার দেয়, অন্যদিকে যখন আমরা অন্য মানুষের সংস্পর্শে আসি; তখন সেই মানুষের অধিকারকে সন্মান ও রক্ষা করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। 

সুতরাং “হক্ক” শব্দটি কেবল তার সত্য বা বাস্তবতাকেই বোঝায় না বরং আমাদের উপর এর ন্যায় ও ন্যায়সঙ্গত দাবিকেও নির্দেশ করে। যখন আমরা কোনো কিছুর অধিকার উপলব্ধি করি, তখন আমরা কেবল তার সত্যতা ও বাস্তবতাই বুঝি না, এর জন্য কী করতে হবে তাও বুঝতে পারি। এটি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির বস্তুনিষ্ঠ সত্য এবং প্রকৃত বাস্তবতাকে মনোনীত করে না বরং যারা এটির সম্মুখীন হয় তাদের জন্য বিষয়গত বাধ্যবাধকতা এবং অভ্যন্তরীণ দায়িত্বও তৈরি করে। যেহেতু আল্লাহ প্রতিটি মানুষের স্রষ্টা, তাই তাঁর প্রদত্ত প্রতিটি অধিকার সার্বজনীন, এবং আমাদের সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এটি আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত অধিকারের জন্য সত্য, জীবনের অধিকার, প্রত্যেককে দেওয়া একটি মৌলিক “অধিকার”। একজনের জীবনের অধিকারকে “হক্ক” হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হল সেই জীবনকে সম্মান ও রক্ষা করার দায়িত্বকেও স্বীকৃতি দেওয়া।

প্রাকৃতিক অধিকার এবং কর্তব্যের উপলব্ধি শুধুমাত্র ঐশ্বরিকের সাথে আমাদের সম্পর্ককে ধারণা করে না বরং অন্যদের সাথে আমাদের মিথস্ক্রিয়া কী হবে তাও নির্ধারণ করে। এর থেকে বোঝা যায় যে আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং অন্যের জীবনের অধিকারকে সম্মান করা হল গভীর নৈতিক বাধ্যবাধকতা যা আল্লাহ প্রদত্ত “অধিকার” স্বীকৃতির মধ্যে নিহিত। এটি একটি উপলব্ধি যে প্রতিটি ব্যক্তি আল্লাহর সৃষ্টির অধীনে একই অধিকার ভোগ করে, জীবনের প্রতি পারস্পরিক সম্মানের গুরুত্বের উপর জোর দেয়। অতএব, “হক্ক” শুধু আমাদের অধিকারই দেয় না বরং সেই অধিকার প্রদানকারী আল্লাহর প্রতি এবং বৃহত্তর মানবতার প্রতি আমাদের কর্তব্যের রূপরেখা দেয়।

ইসলামে “হক্ক” (সত্য ও বাস্তবতা) ধারণাটি গভীরভাবে অধিকার এবং কর্তব্য বোঝার সাথে জড়িত। এটি একটি বিস্তৃত কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে যা ব্যক্তি, তার স্রষ্টা এবং বাকি সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি তৈরী করে। অধিকার এবং কর্তব্যের এই আন্তঃসম্পর্ককে বোঝার মাধ্যমে, আমরা আমাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বাধ্যবাধকতার পথ ধরে একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বসবাস করার সারমর্ম শিখি। এই সম্পর্কটি আমাদের প্রতিটি অধিকার দুটি স্তরের কর্তব্যে নিয়ে আসে: প্রথম, স্রষ্টার প্রতি যিনি আমাদেরকে অধিকার দিয়েছেন এবং দ্বিতীয়, তাঁর সৃষ্টি, মানবতার প্রতি যাদেরকেও এই অধিকার দেওয়া হয়েছে।

২.৪ আল্লাহর প্রতি কর্তব্য

প্রথম স্তরের কর্তব্য হল আল্লাহর প্রতি যিনি অধিকার দিয়েছেন।  আল্লাহকে “আল-হক্ক” – চূড়ান্ত সত্য – হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া সকল কর্তব্যের জন্য মৌলিক। এই স্বীকৃতি কেবলমাত্র তাঁর অস্তিত্বের স্বীকৃতি নয় বরং তাঁর সার্বভৌমত্ব, আদেশ এবং মানবতার জন্য তিনি যে উদ্দেশ্যগুলি নির্ধারণ করেছেন তার গভীর উপলব্ধি এবং গ্রহণযোগ্যতা অন্তর্ভুক্ত করে। পূর্বে আলোচিত কোরানের আয়াতে জোর দেওয়া হয়েছে যে আল্লাহ যা কিছু করেন তা সত্য (“হক্ক”), আসমান ও জমিনের সৃষ্টি থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা সহ বার্তাবাহক প্রেরণ পর্যন্ত। এই দায়িত্বটি এই উপলব্ধি থেকে উদ্ভূত হয়েছে যে সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহর সত্যের (“হক্ক”) প্রকাশ, তাই সবকিছুতেই তার অন্তর্নিহিত অধিকার রয়েছে। আল্লাহ সকল অধিকারের উৎস, তাই আমাদের অধিকার দাবী করতে হলে আমাদেরকে সত্য ও বাস্তবে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহই এসবের একমাত্র মালিক ও অধিকারী। এভাবে আমাদের অধিকার আল্লাহর প্রতি কর্তব্য তৈরি করে।

২.৫ সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য

দ্বিতীয় স্তরের কর্তব্য হল সৃষ্টির প্রতি, বিশেষ করে অন্য মানুষ যাদরকেও অধিকার দেয়া হয়েছে।  আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টিকে অধিকার দিয়েছেন এবং আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সৃষ্টির সেই অধিকার সন্মান ও রক্ষা করা। সৃষ্টির প্রতি এই দায়িত্বগুলো আল্লাহর প্রতি আমাদের কর্তব্য থেকে আলাদা নয় বরং এগুলোরই সম্প্রসারণ। সৃষ্টির প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, আমরাও আল্লাহর প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি, যেমন তিনি পৃথিবী ও এর অধিবাসীদের প্রতি দয়া, ন্যায়বিচার এবং তত্ত্বাবধায়কের আদেশ দিয়েছেন।

ইসলামে অধিকার ও কর্তব্যকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ যথাযত পরিপূরক উপাদান হিসেবে দেখা হয়। আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার সংশ্লিষ্ট কর্তব্যের সাথে আসে। এই সম্পর্ক নিশ্চিত করে যে ইসলামে মানবাধিকারের ধারণাটি সামগ্রিক, সমাজের সামষ্টিক কল্যাণের উপর জোর দিয়ে ব্যক্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। এটি ব্যক্তিদের মধ্যে শুধুমাত্র তাদের অধিকার বজায় রাখা নয় বরং আল্লাহ এবং অন্যদের প্রতি তাদের কর্তব্য পালনের জন্য দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। এই ভারসাম্য ইসলামী নৈতিকতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা মানবাধিকার ও দায়িত্ব বোঝার জন্য একটি সামগ্রিক রূপরেখা প্রদান করে।

পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব কীভাবে “হক্ক” তিনটি মৌলিক মানবাধিকারের সাথে কর্তব্য যুক্ত করে: ১) জীবন ও জীবিকার অধিকার, ২) স্বাধীনতা ও পথনির্দেশনার অধিকার এবং ৩) সৃষ্টি করার অধিকার। এই অধিকারগুলির প্রতিটিতে, “হক্ক” শুধুমাত্র এই অধিকারগুলির অন্তর্নিহিত সত্য, সঠিক, এবং যথাযথ বোঝায় না বরং আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলিকেও বোঝায়। এই ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি নিশ্চিত করে যে একজনের অধিকারের প্রয়োগ অন্যের অধিকারের উপর লঙ্ঘন না করে। এইভাবে “হক্ক” হল একটি মৌলিক নীতি যা ইসলামে মানবাধিকার বোঝার এবং প্রয়োগের নির্দেশনা দেয়। “হক্ক” ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ঐশ্বরিক বাধ্যবাধকতা এবং মানবিক ও সামাজিক দায়িত্বের সাথে একীভূত করে।

Shallow Insan

We strive to break the barrier of the superficial form of thinking to understand and explain complex and interrelated designed events and systems.

Leave a Reply