গরু থেকে কি শিক্ষা নিতে পারি : পর্ব – ১.১

understanding-cow

শ্যালো ইনসান পেশায় একজন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। বয়সে জীবনের পড়ন্ত বিকেল অতিক্রম করছেন। উনার শেখার খুব আগ্রহ থাকায় উনি নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়েন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে খবরাখবর রাখেন। তার নিজ ধর্ম ইসলাম সম্পর্কেও পড়াশোনা করেন। ধর্মীয় অনুভূতি ও অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করেন। 

একদিন তিনি চিড়িয়াখানায় গেলেন, পশুপ্রাণী দেখতে ও তাদের সম্পর্কে জানতে।  চিড়িয়াখানায় প্রবেশের পর প্রথমে গরুর সাথে দেখা। গরু দেখেই তার কোরবানি হাটের গরুর কথা মনে পড়লো। কত বাহারি গরু।  হটাৎ সে লক্ষ্য করলো একটা গরু তার দিকে আসছে। কাছে এসেই গরু কথা বলতে শুরু করলো।

গরু: কি আমাকে জবাই দিয়ে মাংস খাবার কথা ভাবছো? 

শ্যালো ইনসান (শ্যাই): অবাক ! হতবুদ্ধি, গরুও কথা বলে?  থতমত খেয়ে বলল, না না খাবার কথা না, দেখার কথা ভাবছি।

গরু: একই কথা, প্রথমে দেখবা তারপর খাবা। যাক, দাড়ি দেখে তো মনে হয় মুসলমান।

শ্যাই: হ্যা, ঠিকই ধরছো। 

গরু: তোমার মুসলমানরা গরুর কথা চিন্তা করলে শুধু খাবার কথা ভাবো। মাংস কি সিনার, ঘাড়ের,  নাকি রানের; রান্না কেমন ভুনা, রেজালা ইত্যাদি  ইত্যাদি। খাওয়া ছাড়া আর কোন চিন্তা আসেনা ? 

শ্যাই: একটু আমতা আমতা করে, না, মানে ..

গরু: তোমাদের পবিত্র কোরআনে, একটা সূরার নাম গরু (বাকারা)? কখনো ভেবেছো ওই সুরাটার নাম গরু কেন? 

শ্যাই: হ্যা আছে, তবে সূরার নাম করণ কেন? একটু চিন্তা করে বলে, কিছু সূরার নাম আছে যা প্রথম শব্দগুলা থেকে নেওয়া যেমন সূরা ইয়াসিন, সূরা রহমান। কিছু সূরা আছে মূল বিষয়বস্তূ থেকে যেমন সূরা ফাতিহা , সূরা ইউসুফ। আবার কোনো বিশেষ শব্দ থেকে সূরার নাম এসেছে যেমন আন-নূর, আল-হাদীদ। আর কিছু রান্ডম পিক – ঘটনা বর্ণিত একটা প্রাণী থেকে নামকরণ যেমন আল-বাকারা, আল-ফিল, আল-নাহাল , আল-নামল  ইত্যাদি।

গরু: হু।  তোমার নাম কি ?  

শ্যাই: আমার নাম শ্যালো ইনসান। 

গরু: নাম শুনেই বুঝা যায় তোমার জ্ঞানের গভীরতা।  তোমরা আসলেই কোনো বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করো না।  যাইহোক, শুনো,  পবিত্র কোরআনে প্রতিটা সূরার নাম তার মূল বিষয়ের সাথে যুক্ত। নামের মধ্যে অনেক শিক্ষা আছে, যদি তোমরা বুঝতা।     

শ্যাই: মানে, কি বলতে চাও তুমি? সূরা বাকারা অর্থাৎ গরুরু মধ্যে অনেক শিক্ষা আছে ? তোমাকে দেখে আমি শিখবো ?  

গরু: ঠিক।  

শ্যাই: সেটা কিভাবে? 

গরু: সূরা বাকারাতে গরুর নামটা কি ভাবে এসেছে? 

শ্যাই: সূরা বাকারাতে গরুর ঘটনা এমন ছিল যে, বানিইস্রাঈল দুটি গোত্র, একটি গোত্রের একজন মানুষের লাশ নিয়ে অপর গোত্রকে দোষারোপ করতে থাকে তার হত্যাকারী হিসাবে। এরই প্র্রেক্ষিতে আল্লাহতালা একটা গরু জবাই করে তার অংশ দিয়ে মৃত ব্যক্তি কে আঘাত করতে বলেন।  গরুর টুকরো দিয়ে মৃত ব্যক্তিকে আঘাত করলে মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে বলে দেয় তার হত্যাকারী কে।  এটাতো একটা ঐতিহাসিক ঘটনা এখানে গরু থেকে শেখার কি আছে? 

গরু: এটাইতো তোমাদের সমস্যা।  আল-কোরআনকে তোমরা সার্বজনীন বলো, আবার ৮০ থেকে ৯০ ভাগ আয়াতকে ঐতিহাসিক ঘটনা বলে গল্প করো। বর্তমান সময়ের জন্য এর ভিতর কোনো শিক্ষা নাই বলে ধরে নাও।  আর বাকি ১০ থেকে ২০ ভাগ আয়াত নিয়ে বর্তমান সময়ের জন্য চিন্তা ভাবনা করো।  সার্বজনীন বলতে তোমরা কি বোঝাও সেটা তোমরা নিজেরাই জানো না।  আল-কোরআনের প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে তোমাদের বর্তমান সময়ের জন্য অনেক শিক্ষা আছে ।  যাইহোক ওই গরুর ঘটনা ও সূরার নামকরণ থেকে শিক্ষা হচ্ছে – 

১) ওই ঘটনায়, গরু হচ্ছে সুরাটা আর তার আয়াত গুলা হচ্ছে গরুর টুকরোর সমতুল্য।  এই সূরা বাকারার আয়াত পড়ে আমল করলে মানুষের মৃত হৃদয় (স্পিরিচুয়াল সেন্সে) জীবন লাভ করে এবং জীবনের সকল বিষয়ে সত্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। সূরা বাকারার আয়াত মৃত (স্পিরিচুয়াল সেন্সে) মানুষকে জীবিত করে।  

“তাই আমরা নির্দেশ দিয়েছিলাম, গরুর টুকরো দিয়ে মৃতদেহকে আঘাত করো। এভাবেই সহজেই আল্লাহ মৃতদেরকে জীবিত করেন, তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শন দেখান যাতে তোমরা বুঝতে পার।” [২:৭৩]. [পরের আয়াত ২:৭৪ টি লক্ষ্য করো]  

২) গরুর মধ্যে যেমন মানুষের জন্য অনেক উপকার ( কানের কাছে এসে, পার্শবর্তী দেশের কাছে জিজ্ঞাসা করো) আছে, তেমনি এই সূরা বাকারা মানুষের দুনিয়ার জীবনে চলার জন্য সব উপকার আছে। যেমন সালাত, রোজা , হাজ্ , যাকাত , লেনদেন , ব্যবসা , দান  ইত্যাদি ইত্যাদি। সূরা বাকারা অনুসরণ করলে দুনিয়ার জীবনে সফলতা তেমনি আখেরাতেও মুক্তি। 

৩) গরুর খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ার দিকে খেয়াল করে দেখো – সে প্রথমে খাদ্য পাকস্থলীর একটি অংশে জমা করে পরে তা চিবিয়ে হজম করে তার উপকারের জন্য। সেরকম কোনো মানুষ যখন মুক্ত মনে (শূন্য কাপ হাতে নেয়ার মতো) আল্লাহরতালার কাছে হেদায়েত লাভের আশায় এই সূরা বাকারা পাঠ করে, আল্লাহরতালা তার মানুষিক কাঠামোতে অমেলা-সালিহার সব কিছু বপন করে দেন। যার ফলে, পরবর্তীতে সেই মানুষিক কাঠামোর আলোকে সে যা কাজ করে তা নেক আমল হিসাবে তার উপকারে আসে। 

শ্যালো ইনসানের মুখ লাল, বিব্রতবোধ করছে। সূরা বাকারা জীবনে অনেক বার পড়েছে  কিন্তু কখনো এভাবে বোঝেনি। গরুর মাঝে এতো শিক্ষা, তাও আবার গরুর কাছ থেকে শিখতে হলো।  

শ্যাই: একটু লজ্জা বোধ নিয়ে,  তোমার প্রথম ২ টি পয়েন্ট বুঝেছি, কিন্তু ৩ নাম্বারটা কি বুঝায় বলবে? 

গরু: জানি এটা বুঝতে অসুবিধা হবে, তবে আমি তোমাকে ভালোভাবে বোঝাতে পারবো না।  আমি একজনের নাম শুনেছি,  কি ভাবে আল্লাহতালা মানুষের ভিতর চিন্তা বপন করে, সেটা সে ভালো বোঝে।  তার নাম নুরুল হুদা। আমার কাছে তার কন্টাক্ট নম্বর নাই, পাইলে তোমাকে জানাবো। ফোন নাম্বার কি বলো?  

শ্যাই: ফোন নাম্বার বলার পর একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করে, সূরা আন-আম গরুর কথা বলার মধ্যে কি শিক্ষা আছে?  

গরু: আল্লাহতালা সূরা আন-আম এ গরুকে হার্ড (herd) পশু হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যার অর্থ হলো এরা অন্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এদের মধ্যে একজন বা গুটিকতককে অন্যরা অন্ধভাবে অনুসরণ করে। অন্ধভাবে অনুসরণকারী মানুষদেরকে গরুর এই চরিত্রের সাথে তুলনা করেছেন।  তোমাকে একটা হিন্টস দেই  – বাছুর তার নাফ্স ও প্রবৃত্তি অনুসরণ করে। সুতরাং বাছুর মানে যে তার নাফ্স ও প্রবৃত্তি অনুসরণ করে।  সামেরীর ঘটনা। গরু ও বাছুর কে এক কাতারে দাঁড় করবা না।     

শ্যাই: কোরবানির গরু জবাইয়ের মধ্যে কি শিক্ষা আছে ?  

‘কোরবানি’ শব্দটি আরবি ‘কুরবান’ থেকে উদ্ভূত, যার মূল আরবি শব্দ ‘কুরব’ – যার অর্থ ‘কাছাকাছি’। কোরবানি দেওয়ার উদ্দেশ্য হল আল্লাহর কাছে আসা। তাহলে কোরবানি হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আল্লাহর কাছাকাছি আসা যায়। যেহূত অন্ধ অনুসরণকারী মানুষিকতার লোকেরা হচ্ছে আনআম এর চরিত্রের মতো। সুতরাং, আনআম পশুদের কোরবানির মূল কথা হল কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অন্ধ অনুসরণ প্রবৃত্তিকে নির্মূল করা এবং নিজের চিন্তার জগৎ অন্যের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখা। সুতরাং গরু (অন্যকে অন্ধভাবে অনুসরণ বা অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ) জবাই করে শুধু এক আল্লাহকে অনুসরণ করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছাকাছি আসা যায়। কোরবানি মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই ছিল, যেটা আদম আলায়হিস্সালাম দুই ছেলের ঘটনার মধ্যে উল্লেখ করা আছে। সূরা মায়েদা ৫:২৭। ইসলামের বহু আগে থেকে আরবের লোকেরা পশু বলিদান দিতো তাদের বিধাতার সন্তুষ্টির জন্য। যেটা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মে এখনো পরিলক্ষিত হয়। 

শ্যাই: সুরা আস সাফফাতে ইব্রাহিম আলায়হিস্সালাম এর ঘটনাটির সাথে কোরবানির কি সম্পর্ক?   

গরু: তোমার সূরা সাফফাতে ইব্রাহিম আলায়হিস্সালাম এর ত্যাগের মহিমা দেখাতে গিয়ে আল্লাহতায়ালাকে নিষ্ঠূর বানাই দিলা। মহান আল্লাহতালা তার প্রিয় বন্ধুকে তার…….. না না আমি আর পারছিনা।  গরু কাঁদতে শুরু করলো….আল্লাহ মহীয়ান ও মহিমান্বিত। সারা পৃথিবীর সমস্ত গাছ যদি কলম হয় আর সমস্ত পানি যদি কালি হয় তবুও মহান সৃষ্টি কর্তার গরীয়ান লিখে শেষ হবে না।  

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কথা চিন্তা করে ও গরুর ক্রন্দনরত অবস্থা দেখে  শ্যালো ইনসানের চোখেও জল আসলো। 

শ্যাই: আচ্ছা ওই বিষয়টা বাদ দেই। তাহলে, গরু খাবার ব্যাপারটা কি? আজকাল অনেক আলেম দেখি হাদিস ঘেটে বলে আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গরুর মাংস খেয়েছেন এমন কোনো হাদিস নাই। উনি নাকি এটাও বলেছেন যে, গরুর দুধে আছে রোগমুক্তি আর মাংসে আছে রোগের উপকরণ। 

গরু: ওই হাদিসটা দুর্বল। সবল হাদিস হচ্ছে উনি নিজে গরু কোরবানি করেছেন কয়েকবার। একবার নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)  তার স্ত্রীর জন্য গরু কোরবানি করেন।  উনি গরু খেয়েছেন এমন হাদিস নাই সেটা ঠিক।  কিন্তু উনি যখন তার স্ত্রীর জন্য গরু কোরবানি করেন, তখন কি আমরা ধরতে পারিনা উনি নিজেও গরুর মাংস খেয়েছেন?  গরুর মাংস খেলে রোগ হবে এমন হলে উনিকি তার স্ত্রীর জন্য কোরবানি করতেন এবং খেতে দিতেন? আমরা যদি উপরের হাদিসকে গ্রহণ করতে চাই তাহলে এভাবে বলা যায়, বেশি বা অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে রোগ হতে পারে।  এখোনকার চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বলে ‘রেড মিট’ শরীরে জন্য ভালো না, খারাপ কোলেস্টোরল বাড়ায়, যা হার্ট এর জন্য ভালো না। তাই মাঝে মাঝে গরুর মাংস ভালো, তাতে শরীরে পুষ্টি আসবে। গরু খাওয়া কমলে কিছু গরুরও জীবন বাঁচবে যাদেরকে দেখে তোমরা সূরা বাকারার কথা মনে করতে পারবে।   

শ্যাই: হ্যা, গরুর মাংসে আমারও কোলেস্টোরল বাড়ে। যাই হোক তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। অনেক কিছু শিখলাম।  আজ তাহলে যাই, আবার আসলে কথা হবে। 

গরু:  শোনো যখন কোনো গরু দেখবা তখন সূরা বাকারা স্মরণ করবা, আর শেষ আয়াতের (২:২৮৬)  দোয়াটি আরবিতে পড়বা। অনেক ফজিলত আছে।  আরবিতে না পারলে বাংলায় চালায় দিও এই বলে, “হে আমাদের পালনকর্তা, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি, তবে আমাদেরকে অপরাধী করো না। হে আমাদের পালনকর্তা!  আমাদের উপর এমন দায়িত্ব অর্পণ করো না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর অর্পণ করেছ, হে আমাদের প্রভূ!  আমাদের দ্বারা ঐ বোঝা বহন করিও না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নাই। আমাদের পাপ মোচন কর। আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের  (হালকা অর্থে)  বিরুদ্ধে আমাদের কে সাহায্যে কর।” 

শ্যাই: চেষ্টা করবো। মুখস্ত করতে হবে।  

গরু: আরেকটা কথা, আমার শিক্ষা ভালো লাগলে   বন্ধুদের কাছে শেয়ার করো।  

শ্যাই:  ফেইসবুক পোস্ট দিয়ে দিবো। চলি তাহলে।  

শ্যালো ইনসান ভাবে গরুর কথাগুলি এবং আশ্চর্য হয় কথার গুরুত্ব নিয়ে।  কিছুদূর  যেতে সে একটা হাতি দেখতে পায়। মনে মনে ভাবে সূরা বাকারাতে অনেক উপকার আছে, কিন্তু সূরা ফিল, কি আছে ? সেটাতো একেবারই ছোট একটা সূরা, তাও আবার পুরাটাই ঐতিহাসিক ঘটনা। সেটার মধ্যে আবার বর্তমান সময়ের জন্য কি শিক্ষা আছে ?  সে সোজা হাতির কাছে গেলো  ………. চলবে………

Shallow Insan

We strive to break the barrier of the superficial form of thinking to understand and explain complex and interrelated designed events and systems.

Leave a Reply